ভোপালের রাজকন্যা আবিদা সুলতান চালাতেন রোলস রয়েস, শিকার করতেন বাঘ
আবিদা সুলতান অন্যান্য রাজকন্যার মতো ছিলেন না। তিনি ছোট করে চুল কাটতেন, বাঘ শিকার করতেন। ছিলেন প্রথম শ্রেণির পোলো খেলোয়াড়। বিমানও চালাতে পারতেন। ৯ বছর বয়স থেকে চালাতেন রোলস রয়েস কোম্পানির গাড়ি।
ভোপালের সাহসী এক পরিবারে জন্ম আবিদার—১৯১৩ সালে। এই পরিবার ১০০ বছরের বেশি সময় ব্রিটিশ-ভারতের ভোপাল রাজ্য শাসন করেছিল। তিনি ছিলেন ভোপালের শেষ নবাব হামিদুল্লাহ খানের বড় মেয়ে। তৎকালীন সমাজে সাধারণ ও মুসলিম নারীদের মধ্যে যে বাঁধাধরা প্রথা ছিল, তা অতিক্রম করে গিয়েছিল এই পরিবার। আবিদাও ব্যতিক্রম ছিলেন না।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে ভোপালের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন আবিদা। এক দশকের বেশি সময় ধরে বাবার মন্ত্রিসভা পরিচালনা করেছিলেন তিনি। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেওয়া খ্যাতনামা সব ব্যক্তির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছিলেন। খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন সাতচল্লিশের দেশভাগের সময়ের সহিংসতা।
২০০৪ সালের আবিদার আত্মজীবনী ‘মোমোয়ারস অব আ রেবেল প্রিন্সেস’ প্রকাশিত হয়। তা থেকে জানা যায়, প্রতিদিন ভোর চারটায় তাঁকে ঘুম থেকে উঠতে হতো। পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করতেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে তাঁর দৈনিক কর্মকাণ্ড শুরু হতো। এর মধ্যে ছিল খেলাধুলা, সংগীতচর্চা, ঘোড়ায় চড়া। পাশাপাশি তাঁকে ঘর মোছা ও গোসলখানা পরিষ্কারও করতে হতো।
এক সাক্ষাৎকারে নিজের শৈশবের স্মৃতিচারণা করেছিলেন আবিদা। তখন বলেছিলেন, ‘মেয়ে হওয়ার কারণে আমরা হীন, এমন কোনো অনুভূতি আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়নি। সবকিছুই ছিল সমতাভিত্তিক। একজন ছেলের যে স্বাধীনতা, আমাদেরও তা–ই ছিল। আমরা ঘোড়ায় চড়তে পারতাম, গাছে উঠতে পারতাম, ইচ্ছেমতো যেকোনো খেলাধুলা করতে পারতাম। কোনো বাধা ছিল না।’
১২ বছর বয়সে আবিদার বিয়ে হয়েছিল পার্শ্ববর্তী আরেক রাজ্য কুরওয়াইয়ের রাজপরিবারের সারওয়ার আলী খানের সঙ্গে। সারওয়ার আলী খান ছিলেন আবিদার শৈশবের বন্ধু ও কুরওয়াই রাজ্যের শাসক। আত্মজীবনীতে তিনি এই বিয়ে নিয়ে হাস্যরসাত্মক বর্ণনা দিয়েছেন।
নিজের বিয়ের সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে আবিদা বলেন, একদিন তিনি চাচাতো ভাইবোনদের সঙ্গে ‘বালিশযুদ্ধ’ করছিলেন। এমন সময় ঘরে আসেন তাঁদের দাদি। একটি বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য তিনি আবিদাকে জামা-কাপড় পরতে বলেন। তবে তিনি যে কনে হতে যাচ্ছেন, তখন পর্যন্ত এ কথা তাঁকে জানানো হয়নি।
আবিদার সংসারজীবন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এক দশকের কম সময়ের মধ্যে তাঁর বিচ্ছেদ হয়। দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। আত্মজীবনীতে আবিদা লিখেছেন, ‘দাম্পত্য জীবন যে এতটা ভয়ংকর ও নিরানন্দ হবে, তা আমি বুঝতে পারিনি।’
বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর আবিদা কুরওয়াই ছেড়ে ভোপালে চলে এসেছিলেন। কিন্তু একমাত্র সন্তান শাহরিয়ার মোহাম্মদ খানকে নিয়ে সাবেক স্বামীর সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল। ছেলে কার হেফাজতে থাকবে, তা নিয়ে বাদানুবাদ চরম আকারে পৌঁছেছিল। এসব নিয়ে আবিদা খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে একটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি।
১৯৩৫ সালের মার্চের এক রাতে তিন ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে কুরওয়াইতে যান আবিদা। প্রবেশ করেন সাবেক স্বামীর ঘরে। একটি রিভলবার বের করে ছুড়ে দেন তাঁর কোলে। তারপর আবিদা বলেন, ‘আমাকে গুলি করো, না হলে আমি তোমাকে গুলি করব।’
এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ছেলের হেফাজত নিয়ে বিতর্কের অবসান হয়েছিল। সিংহাসন সামলানোর পাশাপাশি তিনি একাই ছেলেকে বড় করেছিলেন। ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি ভোপালের মন্ত্রিসভা পরিচালনা করেন। দেশভাগের পর ভোপাল ভারতের মধ্য প্রদেশের অংশ হয়ে যায়।
ভারত ভাগের আগে ব্রিটিশ সরকারের আহ্বানে বেশ কয়েকটি গোলটেবিল আলোচনা হয়েছিল। ভারতের ভবিষ্যৎ সরকারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়াই ছিল ওই আলোচনার লক্ষ্য। এসব আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন আবিদাও। এ সময় মহাত্মা গান্ধী, মতিলাল নেহরু ও জওহরলাল নেহরুর মতো প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর। জওহরলাল নেহরু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন।
আত্মজীবনীতে আবিদা বলেন, তাঁর পরিবার কয়েক পুরুষ ধরে শান্তিপূর্ণভাবে ভোপালে বসবাস করে আসছিল। দেশভাগের পর তিনি সেখানে বৈষম্যের মুখোমুখি হন। তাঁদের সঙ্গে ‘বহিরাগতদের মতো’ আচরণ শুরু হয়। এমন এক পরিস্থিতির মুখে ১৯৫০ সালে সন্তানকে নিয়ে পাকিস্তানে চলে যান তিনি। সেখানে গণতন্ত্র ও নারী অধিকার নিয়ে কাজ শুরু করেন। ২০০২ সালে করাচিতে মারা যান আবিদা।
আবিদা পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পর তাঁর বোনকে ভোপালের সিংহাসনে বসিয়েছিল ভারত সরকার। তবে এখনো আবিদাকে ভোপালের মানুষ স্মরণ করেন। সেখানে এখনো তিনি পরিচিত ‘বিয়া হুজুর’ নামে।