দিল্লি দূষণ, বৃষ্টির আশায় রাজধানী

ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারদিক। দিল্লির পথে হাঁটছেন কয়েক পথচারী। সম্প্রতি তোলা
ছবি: এএফপি

দুই দিন ধরে রাজধানী দিল্লির বাসিন্দারা চাতক পাখির মতো তাকিয়ে রয়েছে আকাশের দিকে, বৃষ্টির আশায়। আবহাওয়া অফিসের আগাম আশ্বাস ছিল, দু-এক দিনের মধ্যেই দিল্লিতে বৃষ্টি হবে। হিমাচল প্রদেশের তুষারপাত তার ইঙ্গিত দিয়েছে। বৃষ্টি হলেই কমে যাবে দিল্লির দূষণ। সাময়িক স্বস্তি পাবে রাজধানী।

গতকাল রোববার পুরো দিন অতিবাহিত। আজ সোমবার সকালের ছবিও তথৈবচ। আকাশ–বাতাস থমথমে। ঘন ছাইরঙা চাদরে ঢাকা গোটা দিল্লি। রোদ ওঠার ছিটেফোঁটা সম্ভাবনাও দৃশ্যমান নয়। একমাত্র ভরসা আবহবিদদের আশ্বাস। বৃষ্টির প্রতীক্ষা।

বৃষ্টি ছাড়া দিল্লির ভয়াবহ দূষণের যে ভিন্ন কোনো গতি নেই, সেই উপলব্ধি রাজধানীর মানুষের হয়ে গেছে। কারণ, দূষণ দূরীকরণে ফি বছর টন টন তেল পুড়েছে। রাধা তবু নাচেনি!

প্রায় ৩০ বছর ধরে এই অসহনীয় দূষণই দিল্লির দিবারাত্রির কাব্য। দূষণে কে কাকে টেক্কা দেয়, দিল্লি না বেইজিং, সেই প্রতিযোগিতা হয়ে উঠেছে অন্তহীন।

অথচ দূষণের কারণগুলো কারও অজানা নয়। হেমন্তের শুরু থেকে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। দীপাবলি, ছটপূজা, গুরুপূর্ণিমার মতো ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠান ও অগুনতি বিয়ের দরুন দিল্লিতে এই সময় দেদার বাজি পোড়ানো হয়। শব্দবাজি যতটা বায়ুদূষণের জন্য দায়ী, ততটাই দায়ী উত্তরের দুই রাজ্য পাঞ্জাব ও হরিয়ানার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ফসলের গোড়া মাঠে জ্বালিয়ে দেওয়ার আবহমানকালের রীতি। গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো দূষণে ইন্ধন জোগায় রাজধানীর চার ধারের নির্মাণযজ্ঞ। মুম্বাই, চেন্নাই ও কলকাতা শহরে প্রতিদিন যত গাড়ি চলে, দিল্লিতে চলে তার চেয়ে বেশি।

সরকারি হিসাবেই প্রতিদিন রাজধানী দিল্লিতে চলা সব ধরনের যানবাহনের সংখ্যা সোয়া কোটি। এর সঙ্গে যুক্ত সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ঔদাসীন্য ও প্রশাসনের অপদার্থতায় ক্রমবর্ধমান শিল্প দূষণ। এসবের মোকাবিলায় ৩০ বছর ধরে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার যা করে চলেছে, তা নিছকই লোক–দেখানো। দূষণের মাত্রা ও প্রকোপ তাই বছরের পর বছর বেড়ে চলেছে। আজ এই প্রতিবেদন লেখার সময় রাজধানীর দূষণ ‘মারাত্মক’। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা ‘আইকিউ’ মাত্রা ৪০০ থেকে ৪৫০–এর মধ্যে!

আইকিউএয়ারের মানদণ্ড অনুযায়ী, স্কোর ৫১ থেকে ১০০ হলে তাকে ‘মাঝারি’ বা ‘গ্রহণযোগ্য’ মানের বায়ু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১০১ থেকে ১৫০ স্কোরকে ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ ধরা হয়। স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে তা ‘অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু। স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে তাকে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু ধরা হয়। ৩০১ থেকে তার ওপরের স্কোরকে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ বা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ধরা হয়।

এ অবস্থার দরুন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বারবার রাজধানী দিল্লিকে ‘গাস চেম্বার’–এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। সর্বোচ্চ আদালতের তর্জন-গর্জন, তিরস্কার, ভর্ৎসনা, হম্বিতম্বিও শেষ পর্যন্ত কাকস্য পরিবেদনায় পর্যবসিত। সরকারের যাবতীয় উদ্যোগের হাল যেন ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’! এই বছর তার টাটকা তাজা নমুনা জ্বলজ্বল করছে।

এ বছর দীপাবলির আগে দিল্লি সরকার রাজধানীতে সব ধরনের আতশবাজির বেচাকেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সুপ্রিম কোর্ট তাতে সায় দেন। প্রথমে ‘গ্রিন ক্র্যাকার’ বা পরিবেশবান্ধব সবুজ বাজিতে এ ছাড় দিলেও পরিবেশবিদদের আপত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট তার ওপরও নিষেধাজ্ঞা মেনে নেন। অথচ দেখা যায়, এ বছর দীপাবলিতে রেকর্ড বাজি পুড়ল।

আম আদমি পার্টির (আপ) রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের দিল্লি পুলিশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিল্লির জনগণ দীপাবলির আকাশ রাঙিয়ে দিল। বিজেপি ও আপের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ছোঁয়াও ছিল তার কারণ। আপকে হেয় করতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতারা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করার পাশাপাশি রাজ্য সরকারের হুকুম না মানার আহ্বানও জানালেন। আপকে হিন্দুবিরোধী আখ্যা দিয়ে তাঁরা ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের বললেন, ধর্মীয় রীতি মেনে বাজি পোড়ানো হোক। পুলিশ নীরব দর্শক সেজে থাকল। ব্যবসায়ীরাও বাণিজ্য করে গেল যথারীতি। দিল্লি ঢুকে গেল গ্যাস চেম্বারে। দীপাবলির পরদিন থেকে সেই যে কালো চাদরে ঢাকা পড়েছে দিল্লি, ধোঁয়াশাচ্ছন্ন (ধোঁয়া ও কুয়াশার সন্ধি) হাল থেকে এখনো মুক্ত হতে পারেনি।

বৃষ্টি তাই একমাত্র ভরসা। দীপাবলির দুই দিন আগে দিল্লির আকাশ-বাতাস নির্মল করে দিয়েছিল এই বৃষ্টিই।

তবে মৌখিক উদ্যোগের কিন্তু খামতি নেই। নেই সুপ্রিম কোর্টের তিরস্কারেরও। পাঞ্জাব-হরিয়ানার রাজ্য সরকারকে তীব্র ভর্ৎসনাও সর্বোচ্চ আদালত করেই চলেছেন। দিল্লিসহ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছেও জানতে চাইছেন তাদের সম্ভাব্য পদক্ষেপ। কিন্তু কাজের কাজ কিছুতেই হয় না। দিল্লি সরকার ঘোষণা করেছিল, ২০-২১ নভেম্বরের পর দূষণ না কমলে রাজধানীতে কৃত্রিম বৃষ্টি ঝরাবে। সে নিয়ে বিস্তর জল্পনা চলেছিল। কারা তা করবে, কত কোটি রুপি সে জন্য খরচ হবে, সব জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। যান চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আনতে নতুন করে ‘জোড়-বিজোড়’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথাও জানানো হয়েছিল।

কিন্তু এক সপ্তাহ কেটে গেছে। কোনো মহলেই কোনো উদ্যোগ নেই। দূষণ ছড়ানো কারখানাগুলো দিল্লির বাইরে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগও দৃশ্যমান নয়। রাজধানীর জায়গায় জায়গায় নির্মল বাতাস ছড়াতে ‘স্মগ টাওয়ার’ তৈরি করা হয় সেই ২০১৯ সালে। আজ রাজধানীর দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড স্বীকার করছে, ওই ‘এয়ার পিউরিফায়ার’ ব্যবস্থা কার্যকর নয়। রাস্তায় রাস্তায় ধুলো ওড়া বন্ধ করতে জল ছিটাতেও দেখা যায়। দূষণ যদিও যে কে সে–ই। অগত্যা বৃষ্টিই একমাত্র ভরসা।