পাকিস্তানের সংকট কি ভারতকেও সমস্যায় ফেলতে পারে
‘পাকিস্তানের যদি পতন হয়, তখন তারা যেন আমাদের নিয়ে না ডোবে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার,’ অনেক বছর আগে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যানকে কথাগুলো বলেছিলেন ভারতের একজন বিশ্লেষক। সেই বার ভারত সফরে এসেছিলেন কুগেলম্যান। কথাগুলো এখনো তাঁর মনে গেঁথে আছে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজনীতি ও অর্থনীতি—দুই দিক দিয়েই সংকটে রয়েছে পাকিস্তান। একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও হতাশাজনক প্রবৃদ্ধি নিয়ে ধুঁকছে দেশটির অর্থনীতি। রয়েছে দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকি। অপর দিকে দুর্নীতির দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের গ্রেপ্তার ঘিরে দেশটিতে ব্যাপক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরানের দ্বন্দ্ব দিন দিন আরও গভীর হচ্ছে।
২০০৮ সালে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের সামরিক শাসনের পতন হয়। নির্বাচনে পরাজিত হন তিনি। এর কয়েক মাস পরেই ভারতের মুম্বাইয়ে পাকিস্তান–সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়।
মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘যখন আপনার প্রতিবেশী শত্রুদেশটির পরিস্থিতি সেরা সময়গুলোতেও অস্থির থাকে, একাধিক রাজনৈতিক চাপের মধ্যে থাকে, বড় আকারের অশান্তি চলে এবং বিশেষ করে যে দেশটিতে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের সঙ্গে সমন্বয় নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে, তখন আপনাকে অবশ্যই শঙ্কায় থাকতে হবে।’
এই শঙ্কা কী নিয়ে? কুগেলম্যান বললেন, এটা এমন না যে পাকিস্তানের সমস্যাগুলো ভারতের ওপর পড়বে। বরং এই সমস্যা সামলাতে গিয়ে পাকিস্তানের নজর হয়তো এমন কিছু বিষয় থেকে সরে যাবে, যেগুলো ভারতের জন্য গভীর ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। যেমন ভারতের জন্য হুমকি হয়ে থাকা সন্ত্রাসবাদ।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হয় ভারত ও পাকিস্তান। দেশ দুটি তখন থেকে তিনটি যুদ্ধে জড়িয়েছে। একটি বাদে সব যুদ্ধই ছিল কাশ্মীর নিয়ে। ২০১৯ সালে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে একটি অভিযান চালায় ভারত। কাশ্মীরে ভারতের সেনাবাহিনীর ওপর সন্ত্রাসী হামলার পর অভিযানটি চালানো হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছিলেন, ওই অভিযানের পর ভারত ও পাকিস্তান পারমাণবিক যুদ্ধের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। পরে ২০২১ সালে একটি সীমান্ত চুক্তির মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
‘মানুষের নজর অন্য দিকে ফেরাতে বা সেনাবাহিনীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাশ্মীরে সামরিক শক্তি জোরদারের ইঙ্গিত দিতে পারেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান। এ কাজ করতে গিয়ে সীমান্তের ওপারে সক্রিয় বিভিন্ন গোষ্ঠীকে উসকে দিতে পারেন তিনি। যদিও পাকিস্তানের হাতে সম্পদের পরিমাণ কমে এসেছে, তারপরও এ ঝুঁকি থেকেই যায়অবিনাশ পালিওয়াল, শিক্ষক, এসওএএস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন
এখন একটা প্রশ্ন ওঠে, প্রতিবেশী পাকিস্তানে অস্থিতিশীলতা ভারতের জন্য আসলেই কি উদ্বেগের? অতীতের দিকে নজর দিলে উত্তর পেতে সুবিধা হবে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। ওই যুদ্ধে ভারতও জড়িয়েছিল। আর ২০০৮ সালে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের সামরিক শাসনের পতন হয়। নির্বাচনে পরাজিত হন তিনি। এর কয়েক মাস পরেই ভারতের মুম্বাইয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কিত সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়।
পাকিস্তানে চলমান সংকট অতীতের চেয়ে বেশি উদ্বেগের বলে মনে করছেন হুসাইন হাক্কানি। তিনি পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত। বর্তমানে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হাডসন ইনস্টিটিউটে গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। হুসাইন হাক্কানি বললেন, ‘পাকিস্তানে এমন একটা সময়ে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা চলছে, যখন দেশটি সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে। আর এখন এস্টাবলিশমেন্টকেও (সেনাবাহিনী) দুর্বল ও বিভক্ত বলে মনে হচ্ছে।’
পাকিস্তানের এই সংকটের বিপরীতে ভারত নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় কী করতে পারে? পাকিস্তানে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত টি সি এ রাঘবানের ভাষ্যমতে, এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে অল্পবিস্তর যে সম্পর্ক টিকে আছে, তা ধরে রাখাটাই ভারতের জন্য ভালো হবে।
এমন সংকটের মধ্যে দুটি পরিস্থিতি সামনে আসতে পারে বলে মনে করছেন মাইকেল কুগেলম্যান। প্রথমটি, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোড়া লাগানোর পথে এগোতে পারে পাকিস্তান। তবে দিল্লি এতে আগ্রহী না–ও হতে পারে। আরেকটি হলো, সীমান্তের ওপারে একটি হামলা চালাতে সন্ত্রাসীদের উৎসাহ দিতে পারে ইসলামাবাদ। কুগেলম্যানের ভাষায়, ‘শেষ যে বিষয়টি পাকিস্তান করতে পারে তা হলো, আরেকটি সংঘাত, এমনকি ভারতের সঙ্গে নতুন একটি সংকট।’
কুগেলম্যানের মতো একই ধারণা লন্ডনের এসওএএস ইউনিভার্সিটির পলিটিকস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের শিক্ষক অবিনাশ পালিওয়ালের। তাঁর মতে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংকটের জেরে সীমান্তে যুদ্ধবিরতি নিয়ে দিল্লির সঙ্গে ইসলামাবাদের চুক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অবিনাশ বলেন, ‘মানুষের নজর অন্য দিকে ফেরাতে বা সেনাবাহিনীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাশ্মীরে সামরিক শক্তি জোরদারের ইঙ্গিত দিতে পারেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান। এ কাজ করতে গিয়ে সীমান্তের ওপারে সক্রিয় বিভিন্ন গোষ্ঠীকে উসকে দিতে পারেন তিনি। যদিও পাকিস্তানের হাতে সম্পদের পরিমাণ কমে এসেছে, তারপরও এ ঝুঁকি থেকেই যায়।’
তবে এই দুই পরিস্থিতির মধ্যবর্তী একটি অবস্থা রয়েছে। সেটিই মূলত ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ অনেকে। যেমন কুগেলম্যান বলছিলেন, ওই অবস্থা হলো, অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যা ঘাড়ে নিয়ে চলা পাকিন্তানের সীমান্ত–সংক্রান্ত ঝুঁকিগুলো সামলানোর সক্ষমতায় ঘাটতি।
এদিকে চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের দিন দিন অবনতি হচ্ছে। সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যেই সংঘাত চলছে। অবিনাশ পালিওয়েল বলেন, এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির চুক্তি ভেঙে যাওয়াটা ভারতের জন্য শুধু কৌশলগত হুমকিই হবে না; বরং তা ভয়ংকর হয়ে উঠবে।
তো পাকিস্তানের এই সংকটের বিপরীতে ভারত নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় কী করতে পারে? পাকিস্তানে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত টি সি এ রাঘবানের ভাষ্যমতে, এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে অল্পবিস্তর যে সম্পর্ক টিকে আছে, তা ধরে রাখাটাই ভারতের জন্য ভালো হবে। আর সীমান্তে শান্তি বজায় রাখতে যুদ্ধবিরতি চুক্তিটিও রক্ষা করতে হবে।
এ নিয়ে হুসাইন হাক্কানির বিশ্বাস, সীমান্তে কড়া নজর রেখে ধীরে চলো নীতি বেছে নিয়েছে দিল্লি, যেন অপ্রস্তুত কোনো পরিস্থিতির মুখে পড়তে না হয়। একই মত মাইকেল কুগেলম্যানেরও। তাঁর ভাষায়, ‘ভারতের সীমান্তরক্ষীরা যেন ব্যর্থ না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।’