মণিপুরের সাধারণ মানুষের ভয় কাটছে না
ভারতের মণিপুর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং গতকাল বৃহস্পতিবার গভীর রাতে এক বার্তায় স্বীকার করেছেন, গত দুই দিনের সহিংসতায় রাজ্যে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। তবে তিনি নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা উল্লেখ করেননি। তবে দ্য ওয়্যারসহ কয়েকটি গণমাধ্যমের খবর বলছে, দুই দিনের সহিসংতায় অন্তত ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী বৃহস্পতিবার রাতে স্বীকার করেছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় জোরালো সংঘর্ষ হয়েছে, লুটপাট এবং সহিংসতার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে।
বীরেন সিং বলেন, ইম্ফল, সুসানপুর, বিষ্ণুপুর, কাংপোকপি, মোরে (অতিরিক্ত অঞ্চল) প্রভৃতি জায়গায় হিংসার ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় মানুষের সম্পত্তির যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। সমাজের দুই অংশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ভুল–বোঝাবুঝির কারণেই এই সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সরকার জানমাল রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই বাড়তি আধা সামরিক বাহিনী চেয়ে পাঠানো হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘস্থায়ী বঞ্চনার যে অভিযোগ উঠেছে, তা মাথায় রেখে আলাপ-আলোচনা করা হবে। তবে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন হিংসা ছড়ানোর চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে।
তবে মণিপুরের সাধারণ মানুষের বক্তব্য, পরিস্থিতি সরকার বা সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নেই। পশ্চিম মণিপুরের বিজেপির জনজাতি সমাজের এমএলএ ভুংজাগিন ভাল্টে ইম্ফলে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসার জন্য দিল্লিতে নেওয়া হয়েছে। কংগ্রেসের তরফে জানানো হয়েছে, তাদেরও একাধিক নেতা আক্রান্ত হয়েছেন।
সব সম্প্রদায়কে নিয়ে গঠিত মণিপুরের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি সংগঠন অল মণিপুর ইউনাইটেড ক্লাবস অর্গানাইজেশনের (অমোকো) সভাপতি ফেইরোইজ্যাম ন্যান্ডো লুয়াং ইম্ফল (পশ্চিম) জেলা থেকে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। ইন্টারনেট ও অধিকাংশ অঞ্চলে টেলিফোন পরিষেবা বন্ধ থাকায় বেশি সময় কথা বলতে পারেননি।
ন্যান্ডো লুয়াং টেলিফোনে মণিপুরের অন্তত দুটি জেলা ইম্ফল (পশ্চিম) ও চূড়াচাঁদপুরের যে চিত্র দিলেন তা খুব সুখকর নয়। এই দুই জেলা প্রবল ক্ষতিগ্রস্ত জানিয়ে তিনি বলেন, এই দুই জেলায় বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। তবে তিনি সঠিক সংখ্যা জানাতে পারেননি। মেইতেই এবং কুকি—দুই পক্ষের মানুষই মারা গেছেন।
লুয়াং বলেন, রাজ্যের মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। সেখানে এখনো সহিংসতা কমেনি। রাজ্যের অন্যান্য জেলাও সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
২০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত অমোকোর প্রধান কাজ আঞ্চলিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারকে সাহায্য করা। লুয়াং বলেন, অমোকোর তরফে সমতলের মেইতেই সমাজের কাছে পৌঁছানো গেছে। পার্বত্য অঞ্চলে কুকিসহ অন্যান্য উপজাতি সমাজের মানুষের কাছে এখনো যাওয়া যায়নি।
লয়াং বলেন, যে অঞ্চলে যারা শক্তিশালী, তারা সেই অঞ্চল পাহারা দিচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চলে যাতায়াতের রাস্তাঘাট বন্ধ। এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ, মেইতেই অধ্যুষিত এলাকা বিশেষ করে ইম্ফলে কুকিসহ অন্যান্য উপজাতির মানুষের নিরাপত্তা এবং উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় মেইতেইদের রক্ষা করা।
৩০টি জাতি-গোষ্ঠী রয়েছে এমন উপজাতীয় সমাজের বক্তব্য হচ্ছে, মণিপুর সরকার মেইতেই সমাজের হয়ে কাজ করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুকি সম্প্রদায়ের এক স্কুলশিক্ষক বলেন, উপজাতি গোষ্ঠীগুলো বেশ পিছিয়ে রয়েছে। হিন্দু মেইতেইরা যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। তাদের আরও বাড়তি সুযোগ–সুবিধা দিতে তাদের সংরক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে সরকার, যা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। প্রধানত কুকি, নাগা, পেইতেই, যমিসহ প্রধান প্রধান পার্বত্য উপজাতি জনগোষ্ঠী মেইতেইদের আদিবাসী সংরক্ষণের বিরোধিতা করছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসাম রাইফেল ও ভারতীয় সেনাবাহিনী মিলিয়ে মণিপুরে প্রায় ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। যাবতীয় ট্রেন বাতিল করা হয়েছে এবং ১১ হাজার মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
প্রবল উত্তেজনা রয়েছে
দক্ষিণ-পশ্চিম মণিপুরের চূড়াচাঁদপুর জেলার নিউ লমকা গ্রামের (শহরের কাছেই অবস্থান) থাঙ্গলিয়ানমুং নেইসিয়াল মেঘালয়ের নর্থ ইস্টার্ন হিল ইউনিভার্সিটির (নেহু) আইন বিভাগের পিএইচডি ছাত্র। তিনি আটকে পড়েছেন নিউ লমকায়। তিনি টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি যথেষ্ট উত্তেজনা পূর্ণ। মাঝেমধ্যে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে এবং আকাশে হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। নানা গুজব ছড়াচ্ছে, যাতে উত্তেজনা আরও বাড়ছে। ইম্ফল শহরে নেইসিয়ালের পরিবারও আক্রান্ত হয়েছে।
নেইসিয়াল বলেন, তাঁর দিদির গাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে এবং যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্য, সনদ, কাগজপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভেইপেই নামের আরেকটি উপজাতি গোষ্ঠীর যুব সংগঠনের সভাপতিকেও হত্যা করা হয়েছে।
নেইসিয়াল বলেন, রাজ্যে সাধারণ খাবারদাবার অপর্যাপ্ত হয়ে পড়েছে। উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, তিনি নিজে আজ স্থানীয় দোকানে আলু কিনতে গিয়ে দেখেন, আলুসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন জিনিসপত্র প্রায় শেষ।
চূড়াচাঁদপুরের স্থানীয় কয়েক বাসিন্দা বলেন, অস্ত্র হাতে তরুণদের ছাদবিহীন বড় গাড়িতে ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর তরফে নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে তরুণদের রাস্তায় নামার আহ্বান জানানো হচ্ছে। কিছু কিছু এলাকায় সেনাবাহিনী পৌঁছাতে পেরেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মার্কিন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী বলেন, ‘আফ্রিকায় হুতু ও টুটসি সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতা এবং গণহত্যার সময় যে ধরনের ছবি দেখা গিয়েছিল, তা কোনো দিন নিজের গ্রামে দেখতে হবে, ভাবিনি। গত দুই দিনে তা দেখতে হলো।’
মণিপুরের সঙ্গে মিয়ানমারের দীর্ঘ সীমান্ত থাকায় মিয়ানমারের অংশে চূড়ান্ত সতর্কতা জারি করা হয়েছে বলে ওই দেশের সামরিক গোয়েন্দার একটি সূত্র প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে।