ভারতের অর্থনীতিকে খাদের কিনারা থেকে তুলে এনেছিলেন মনমোহন
বিরোধীরা তাঁর নাম দিয়েছিল ‘মৌনমোহন’। কারণ, তিনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলতেন না। নীতিপঙ্গুত্বের অভিযোগে বিরোধীরা তাঁকে কাঠগড়ায় তুলতেও ছাড়েনি। ভাবমূর্তিতে দুর্নীতির কালি ছিটাতেও তারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি। রাজনীতির ভাষায় প্রতিবাদ করতে তিনি জানতেন না। তাই অপবাদের প্রত্যুত্তর দিতে পারেননি। শুধু বলেছিলেন, ‘আশা করি ইতিহাস আমাকে অন্যভাবে মনে রাখবে। আমার প্রতি সদয় হবে।’
মনমোহন সিংয়ের প্রয়াণের পর সেই সমালোচকেরাও আজ স্বীকার করছেন, আধুনিক ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণের জনক তিনিই। ভারত আজ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যেটুকু সম্ভ্রম আদায় করতে পেরেছে, তার কৃতিত্ব মনমোহন সিংকেই দিতে হবে।
হয়তো সেই সঙ্গে নিভৃতে এ কথাও স্বীকার করছেন, তাঁর দ্বিতীয় দফার শাসনকালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির পাহাড় প্রমাণ অভিযোগ আনাটাও ছিল ভুল। কয়লাখনি বণ্টন কেলেঙ্কারি, টু জি স্পেকট্রাম বা কমনওয়েলথ কেলেঙ্কারির অভিযোগের তিরে তাঁকে বিদ্ধ করার চেষ্টা হলেও কোনো তদন্তই তাঁকে দোষী ঠাওরাতে পারেনি। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি যে দুর্নীতিতে ডুবে থাকতে পারেন, জনগণ সে কথা বিশ্বাস করতে চায়নি।
বাবার কথা শুনে চললে অর্থনীতিবিদ নয়, মনমোহন সিংয়ের পরিচিতি হতো চিকিৎসক হিসেবে। বাবা গুরমুখ সিং কোহলি চেয়েছিলেন স্কুল শেষ করে ছেলে চিকিৎসায় পড়ুক। বাবার ইচ্ছাকে মর্যাদা দিতে মনমোহন মেডিকেল কলেজে ভর্তিও হন।
নিজের প্রতি সেই বিশ্বাস মনমোহনের ছিল বলেই অভিযোগ ও রাজনৈতিক দুশমনির জবাবে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেষ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘সংবাদমাধ্যম ও বিরোধীরা আমার প্রতি নির্দয় হলেও আমার বিশ্বাস, ইতিহাস ততটা নির্দয় হবে না। আশা করি ইতিহাস আমাকে অন্যভাবে মনে রাখবে। আমার প্রতি সদয় হবে।’
নিজের প্রতি ধারণা বা নিজেকে নিজের মূল্যায়নে মনমোহন ভুল করেননি। দেশবাসী তাঁকে স্বচ্ছ, ভদ্র, নম্র, মৃদুভাষী অথচ লক্ষ্য অর্জনে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তার জন্যই মনে রেখেছে। মৃত্যুর পরে তা আরও বেশি করে প্রমাণিত। রাজনীতির ঊর্ধ্বে ওঠা তিনিই এ দেশের শেষ প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ক।
অথচ বাবার কথা শুনে চললে অর্থনীতিবিদ নয়, মনমোহন সিংয়ের পরিচিতি হতো চিকিৎসক হিসেবে। বাবা গুরমুখ সিং কোহলি চেয়েছিলেন স্কুল শেষ করে ছেলে চিকিৎসায় পড়ুক। বাবার ইচ্ছাকে মর্যাদা দিতে মনমোহন মেডিকেল কলেজে ভর্তিও হন। মনমোহন–কন্যা দামন সিং তাঁর লেখা ‘স্ট্রিক্টলি পার্সোনাল: মনমোহন অ্যান্ড গুরশরণ’ বইয়ে এই কথা জানিয়ে লিখেছেন, বাবার কথায় মেডিকেলে ভর্তি হলেও তিনি খুশি ছিলেন না। অর্থনীতি তখন তাঁকে টানছে।
মাস কয়েকের মধ্যেই মেডিকেলে পড়া ছেড়ে দেন মনমোহন। অমৃতসর হিন্দু কলেজে অর্থনীতিতে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক হয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারপর সাগর পাড়ি। অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষালাভের পর দেশে ফিরে প্রথমে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়, তারপর দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিকসে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯, তিন বছর জাতিসংঘে কাটিয়ে দেশে ফিরে ১৯৭২ সালে যোগ দেন ভারত সরকারে, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে।
চার বছর (১৯৭২–৭৬) ভারত সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, ১৯৮২–৮৫ রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর ও ১৯৮৫–৮৭ যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন মনমোহন। এরপরই তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ একেবারে আচমকাই। সেই কাহিনিও চমকপ্রদ। ১৯৯১ সালের জুন। নেদারল্যান্ডসে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে দিল্লি ফিরেছেন ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান মনমোহন সিং। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি ঘোচাতে শুয়ে পড়েছেন। গভীর রাতে ফোন বাজল। ধরলেন মনমোহনের কন্যার স্বামী বিজয় তনখা। ফোনের ওপারে প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের অতি ঘনিষ্ঠ আমলা পি সি আলেকজান্ডার। বললেন, ঘুমিয়ে পড়লেও বাবাকে জাগাতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ।
নির্দেশ সত্ত্বেও বিশেষ গুরুত্ব দেননি মনমোহন। দিনটি ছিল ২১ জুন। সকালে যথারীতি ইউজিসি অফিসে গেছেন। কিন্তু তড়িঘড়ি তাঁকে ফিরে আসতে হয় বাড়িতে। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে দেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিতে চান। রাষ্ট্রপতি ভবনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মনমোহন সিংকে দেখে সবাই তাজ্জব। কন্যা দামন সিং লিখেছেন, রাষ্ট্রপতি ভবনে যাওয়ার আগেই বাবাকে নতুন দায়িত্বের কথা জানিয়ে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওই। যদিও তা ঘোষিত হয়নি।
দিনটি ছিল ২১ জুন। সকালে যথারীতি ইউজিসি অফিসে গেছেন। কিন্তু তড়িঘড়ি তাঁকে ফিরে আসতে হয় বাড়িতে। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে দেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিতে চান। রাষ্ট্রপতি ভবনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মনমোহন সিংকে দেখে সবাই তাজ্জব।
সেই সময়কার ভারতীয় অর্থনীতি ছিল শঙ্কাজনক। আগের প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) থেকে দেশের সোনা গচ্ছিত রেখে। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় তলানিতে। ভাঁড়ারে মাত্র ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, সেই সময়কার হিসেবে মাত্র আড়াই হাজার কোটি ডলার, যা দিয়ে বড়জোর দুই সপ্তাহের প্রয়োজনীয় আমদানি বিল মেটানো যায়। জলের মতো বিদেশি মুদ্রা বেরিয়ে যাচ্ছে। চড়চড় করে বেড়ে মুদ্রাস্ফীতি দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে গেছে। মূল্যবৃদ্ধিও লাগামছাড়া। বৈশ্বিক ব্যাংকগুলো ভারতকে ঋণ দিতে অস্বীকার করছে। অর্থনীতি চুরচুর করে ভেঙে পড়ছে।
দেশের অর্থনীতির হাল কেমন, মনমোহন সিংয়ের তা জানা ছিল। সমস্যার মতো সমাধানের রাস্তাও ছিল জানা। কালক্ষেপণ না করে তাই তিনি কাজে নামতে দেরি করেননি। রিজার্ভ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর তখন সি রঙ্গরাজন। তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে কয়েক দিনের ব্যবধানে দুই খেপে প্রথমেই তিনি ডলারের বিপরীতে রুপির অবমূল্যায়ন করেন। ঘোষিত হয় নতুন শিল্পনীতি। তুলে নেওয়া হয় রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা। এ ক্ষেত্রে তিনি সহায়তা পান বাণিজ্যমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের। পরের মাসেই পেশ করেন তাঁর প্রথম বাজেট। লাইসেন্স পারমিট রাজের দিন শেষ করে দেশের অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করার সেই শুরু।
দেশ দেখল, মাত্র ১৮টি ক্ষেত্র ছাড়া সর্বত্র শিল্পে লাইসেন্স প্রথা তুলে দেওয়া হলো। মোট ৩৪ শিল্পে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের অনুমোদিত হলো। বহু ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থার একচেটিয়া অধিকার খর্ব হলো। রুগ্ণ সরকারি সংস্থা থেকে ক্রমেই হাত গুটিয়ে নেওয়ার পর্ব শুরু হলো। হাত দিলেন ব্যাংকিং নীতি সংস্কারে। খুলে দেওয়া হলো বেসরকারি ব্যাংকের দরজা।
ভারতীয় স্টক মার্কেটে বিদেশি লগ্নির দরজা খুলে দেওয়া হলো। শুরু হলো মিউচুয়াল ফান্ড। সরকারি সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থারও। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক ‘সেবি’র হাতে দেওয়া হলো আরও ক্ষমতা। ক্রমেই ঘুরে দাঁড়াতে থাকল অর্থনীতি। প্রতিযোগিতা ক্রমেই বাড়িয়ে তুলতে থাকে দক্ষতা। এতে অবশ্যই অখুশি হয়েছিলেন তাঁরা, এতকাল যাঁরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও দাক্ষিণ্যে ব্যবসা–বাণিজ্য চালাচ্ছিলেন। ভারতীয় অর্থনীতিতে যাঁদের পরিচিতি ছিল ‘বম্বে ক্লাব’ সদস্য বলে। কিন্তু নরসিমা রাওয়ের সমর্থনে মনমোহন সিং সব বাধা কাটিয়ে এগিয়েছিলেন।
মনমোহন যখন অর্থমন্ত্রী হন, তখন ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে ছিল মাত্র ১০০ কোটি ২০ লাখ ডলার। দুই বছরে তা বেড়ে হয় ১ হাজার কোটি ডলার।
মনমোহন সিংয়ের ওপর অর্থনৈতিক দায়িত্ব সঁপে নরসিমা রাও যেমন ভুল করেননি, তেমনই সঠিক কান্ডারি বেছে নিতে কুণ্ঠিত হননি সোনিয়া গান্ধীও। কংগ্রেস দল ও তাঁর নির্বাচনী শরিকদের সবাই যখন ২০০৪ সালে উপঢৌকনের ডালি সাজিয়ে সোনিয়া গান্ধীর হাতে প্রধানমন্ত্রিত্ব তুলে দিতে উন্মুখ, রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বেরিয়ে কংগ্রেস সভানেত্রী তখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিংয়ের নামই ঘোষণা করেছিলেন। ২০০৪ সালের ২২ মে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবার শপথ নেন মনমোহন সিং। পাঁচ বছর পর ২০০৯ সালে ওই দিনে দ্বিতীয়বারের জন্যও।
নাগরিকদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র, যার পোশাকি নাম ‘আধার কার্ড’, তার যাত্রা শুরুও মনমোহন সিংয়ের হাত ধরে। আর পাস করিয়েছিলেন মানুষের তথ্য জানার অধিকার আইন, সারা দেশে যা ‘আরটিআই’ বলে পরিচিত।
প্রধানমন্ত্রী হয়েও বৈপ্লবিক সব পরিবর্তন এনেছিলেন মনমোহন সিং। দারিদ্র্য দূরীকরণে ২০০৫ সালে চালু করেন এক শ দিনের কাজের প্রকল্প, পরবর্তী সময়ে যা ‘মনরেগা’ নামে পরিচিত। সেটাই ছিল দরিদ্রদের জন্য তাঁর কাজের গ্যারান্টি। ভারত–যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তির সিদ্ধান্ত শুধু বৈপ্লবিকই ছিল না, ওই চুক্তি আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের আসন অন্য উচ্চতায় স্থাপন করেছিল। সেটা ছিল আক্ষরিক অর্থেই পররাষ্ট্রনীতির এক নতুন মাইলফলক।
প্রাথমিক শিক্ষার অধিকার, আদিবাসী অধিকার, খাদ্য সুরক্ষা আইন, জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন আইনও মনমোহনেরই করা। খাদ্য সুরক্ষা আইনের আওতায় তিনি চালু করেছিলেন গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা। ভর্তুকির অর্থ সরাসরি উপভোক্তার ব্যাংক খাতায় পাঠানোর কাজও মনমোহন সিংই প্রথম শুরু করেছিলেন। নাগরিকদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র, যার পোশাকি নাম ‘আধার কার্ড’, তার যাত্রা শুরুও মনমোহন সিংয়ের হাত ধরে। আর পাস করিয়েছিলেন মানুষের তথ্য জানার অধিকার আইন, সারা দেশে যা ‘আরটিআই’ বলে পরিচিত।
তিস্তা চুক্তি সই হতে হতেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসহযোগিতায় না হওয়া, বিজেপির প্রবল বিরোধিতার কারণে স্থলসীমান্ত চুক্তি সই করতে না পারা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিংয়ের ব্যর্থতা বলে অবশ্যই চিহ্নিত হবে। মণিপুরের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগের জন্য বাংলাদেশিদের সমালোচনাও তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু কংগ্রেস আমলে ভারত–বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নতিতে তাঁর সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা কখনো প্রশ্নের মুখে পড়েনি।
ব্যতিক্রমী রাজনীতিক হিসেবে শ্রদ্ধা ও সম্মানের আসন অজাতশত্রু মনমোহন সিংয়ের জন্য পাতাই থাকবে। চিরকাল তিনি পরিচিত থাকবেন আধুনিক ভারতের অর্থনীতির রূপকার ও নিষ্কলঙ্ক রাষ্ট্রনেতা হিসেবে, যিনি কখনো ‘রাজনীতিক’ হয়ে উঠতে পারেননি। চানওনি।