মোদি কি তাহলে যোগীকে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দিতে চান, বিজেপিতে চাপান–উতোর

উত্তর প্রদেশের বারানসিতে মোদির সঙ্গে প্রার্থনায় মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। ১৮ জুনছবি: এএনআই

ভারতের দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল যে স্রেফ আন্দাজে ঢিল ছোড়েননি, বেশ বোঝা যাচ্ছে। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ডানা ছাঁটার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। কীভাবে তা হবে, মুখ্যমন্ত্রী পদে তাঁকে রেখে, নাকি সরিয়ে দিয়ে—এ মুহূর্তে সেই জল্পনাতেই শাসকদলীয় রাজনীতি গমগম করছে।

কেজরিওয়াল এই ভবিষ্যদ্বাণীই করেছিলেন নির্বাচন চলাকালে, ২১ মে। একবার নয়, দুবার নয়, বেশ কয়েকবার ভণিতা না করেই বলেছিলেন, নরেন্দ্র মোদি ফের ক্ষমতায় এলে দুই মাসের মধ্যেই যোগী আদিত্যনাথকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেবেন। বসাবেন এমন একজনকে, যিনি হবেন তাঁদের একান্ত অনুগত। ‘ইয়েস ম্যান’। কেন তা করবেন, সেই ব্যাখ্যাও কেজরিওয়াল দিয়েছিলেন । বলেছিলেন, মোদি চান অমিত শাহকে উত্তরাধিকার করে যেতে। যোগী সেই লক্ষ্য পূরণের পথের কাঁটা।

কী আশ্চর্য, লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের পর দুমাসও কাটেনি, বিজেপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এই সম্ভাবনা নিয়েই গমগম করছে! দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গেছে উত্তর প্রদেশ বিজেপি। একদিকে রয়েছেন গেরুয়াধারী মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, অন্যদিকে মোদি–শাহ ঘনিষ্ঠ উপমুখ্যমন্ত্রী কেশব প্রসাদ মৌর্য। দলীয় কোন্দল এমন সময়ে তুঙ্গে উঠেছে, যখন রাজ্যের ১০ বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে যৌথভাবে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র দুই শরিক সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেস।

মৌর্য শিবিরের অভিযোগ, যোগীর ‘অপশাসন, ঔদ্ধত্য, বুলডোজার নীতি ও অতিরিক্ত আমলানির্ভরতা’ ভোট বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। গত রোববার লক্ষ্ণৌয়ে নির্বাচনী ফল বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার জন্য এক বৈঠক ডাকা হয়েছিল। সেখানেই চলে মৌর্য শিবিরের সঙ্গে যোগী ঘনিষ্ঠদের বিবাদ ও পারস্পরিক দোষারোপের পালা।

যোগীশিবিরের বিশ্লেষণ, দলীয় কর্মীদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই ভরাডুবির কারণ। তাঁরা ভেবেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী একাই দলকে তরিয়ে দেবেন। তাঁর ভাবমূর্তিই সব। কারও কিছু করার দরকার নেই। সেই কারণে সংগঠন ঢিলেঢালা হয়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া, রাজ্যের মতামত অগ্রাহ্য করে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বহু অযোগ্যকে প্রার্থী করেছে। ফলে যা অবধারিত তা–ই হয়েছে।

মৌর্য শিবিরের পাল্টা অভিযোগ, রাজ্য সরকার দলীয় কর্মীদের গুরুত্বহীন করে রেখে আমলাশাহির ওপর ভরসা রেখেছিল। মানুষ ক্ষুব্ধ ছিল সরকারি ও আমলাশাহির ঔদ্ধত্যে। রাজ্য প্রশাসন ভেবেছিল, বুলডোজার নীতি সরকারকে জনপ্রিয় করে তুলবে। কিন্তু সত্য হলো, বুলডোজার চালিয়ে সব সময় সব মানুষের মন জেতা যায় না।

সেই বৈঠকেই উপমুখ্যমন্ত্রী কেশব প্রসাদ মৌর্য বলেছিলেন, ‘সরকারের চেয়ে দল সব সময় বড়।’

গত রোববারের ওই বৈঠকের পর দ্রুত বদলে যায় রাজ্য রাজনীতির সমীকরণ। এত দিন যা ছিল অভ্যন্তরে, ওই দিন থেকেই তা প্রকাশ্যে চলে আসে। গত সোমবার দিল্লি চলে আসেন উপমুখ্যমন্ত্রী মৌর্য। দলের সভাপতি জেপি নাড্ডার সঙ্গে দেখা করে তিনি তাঁর অসন্তোষের কথা জানান।

দলীয় সূত্রের খবর, যোগীর কাজকর্মে অসন্তুষ্ট মৌর্য নাকি পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এই পরিস্থিতিতে তড়িঘড়ি দিল্লিতে ডেকে পাঠানো হয় দ্বিতীয় উপমুখ্যমন্ত্রী ব্রজেশ পাঠক ও উত্তর প্রদেশের বিজেপি সভাপতি ভূপেন্দ্র চৌধুরীকে। ভূপেন্দ্র দিল্লি এসে দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে। শোনা যাচ্ছে, দলের ফল আশানুরূপ না হওয়ায় দায় গ্রহণ করে তিনিও পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

এই পরিস্থিতিতে গতকাল বুধবার মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ দলের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ডাকেন। সেখানে ১০ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়। সেই বৈঠকে দুই উপমুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য সভাপতিরা উপস্থিত ছিলেন না।

দলীয় সূত্রের খবর, ১০ আসন জেতার জন্য মুখ্যমন্ত্রী ৩০ মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছেন। যদিও উপনির্বাচন কবে হবে, সেই তারিখ নির্বাচন কমিশন এখনো জানায়নি। মনে করা হচ্ছে, চলতি বছরের শেষে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা ও ঝাড়খন্ড বিধানসভার নির্বাচনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন ওই ১০ আসনের উপনির্বাচন করাবে। সে ক্ষেত্রে দুপক্ষই সময় পাবে।

যে ১০ আসনের উপনির্বাচন, সেগুলোর মধ্যে পাঁচটি জিতেছিল সমাজবাদী পার্টি। বাকি পাঁচ আসনের মধ্যে তিনটি ছিল বিজেপির জেতা, দুটি পেয়েছিল তাদের দুই সহযোগী দল নিষাদ পার্টি ও আরএলডি। সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেস প্রাথমিকভাবে একজোট হয়ে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কংগ্রেস চাইছে, বিজেপি ও তার সহযোগীরা যেসব আসনে জিতেছিল, সেগুলো তাদের ছেড়ে দেওয়া হোক।

যোগী শিবির মনে করছে, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব খারাপ ফলের জন্য পুরোপুরি তাঁকে দায়ী করছে, যাতে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া সহজ হয়। এই মহলের মতে, প্রধানমন্ত্রী মোদি চান না যোগী আদিত্যনাথ ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার হয়ে উঠুন। অমিত শাহর পথের কাঁটা সরাতে তাই এখন থেকেই তৎপরতা শুরু হয়েছে।

বিজেপির এই কোন্দলে ঘি ছড়াতে দেরি করেননি সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব। লোকসভা ভোটে রাজ্যের মোট ৮০টি আসনের মধ্যে ৩৭টি জেতার পর অখিলেশের নজরে এখন লক্ষ্ণৌয়ের তখত। গত বুধবার তিনি বলেন, ‘বিজেপিতে শুরু হয়ে গেছে কুর্সি দখলের লড়াই। প্রশাসন ভেঙে পড়েছে। যে দল এত দিন ধরে বিরোধীদের দল ভাঙিয়ে রাজনীতি করে চলেছে, আজ তাদের ঘরই ভাঙনের মুখে।’

যোগী আদিত্যনাথকে ক্ষুব্ধ করে বিজেপি উত্তর প্রদেশে রাজত্ব করতে পারবে কি না, এই ডামাডোলে সেই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে চর্চায় চলে এসেছে জেলবন্দি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির (এএপি) নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ভবিষ্যদ্বাণী।