২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

কর্ণাটকের সাবেক শিক্ষামন্ত্রীকে অন্তরালে পাঠাল হিজাব

হিজাব
প্রতীকী ছবি

হিজাবই অন্তরালে পাঠিয়ে দিল বি সি নাগেশকে। রাজনৈতিক জীবনের বড় এক শিক্ষা পেলেন ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের সাবেক এই শিক্ষামন্ত্রী।

এটুকু পড়ে মনে হতে পারে, কে নাগেশ আর কেনইবা হিজাবের অবতারণা। কর্ণাটকে বহুচর্চিত এই মানুষটিই সরকারি স্কুলের মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরে ক্লাস না করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। দেড় থেকে পৌনে দুই বছর আগের সেই ফরমানে উত্তাল হয়েছিল রাজ্য। রেশ ছড়িয়েছিল দেশের অন্যত্রও। অনুরোধ-উপরোধে কাজ না হওয়ায় দাবি-আন্দোলনের পথে নেমেছিল সমাজের একাংশ। তাতেও নির্দেশ অপরিবর্তিত থাকায় আইন-আদালতের পথে যাওয়া শুরু হয়। সুপ্রিম কোর্ট এখনো সেই মামলার রায় শোনাননি।

তবে রায় দিয়েছে কর্ণাটকের জনতা। টুমকুর জেলার টিপটুর কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রার্থীর কাছে সাড়ে ১৭ হাজারেরও বেশি ভোটে হেরেছেন নাগেশ।

হিজাব নিষিদ্ধকরণ নাগেশকে দেশের সর্বত্র পরিচিতি দিয়েছিল। হিজাবই তাঁকে পাঠিয়ে দিল অন্তরালে!

আরও পড়ুন

নাগেশ একা নন, কর্ণাটকে জনতার রায়ে বাসবরাজ বোম্মাই মন্ত্রিসভার ২৫ জন মন্ত্রীর মধ্যে ১২ জনই এবার হেরেছেন। জনতার রায়ে খড়কুটোর মতো ভেসে গেছে সব। এমনকি ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তিও। আগামী বছর লোকসভা ভোটে কী হবে, সেটা পরের কথা; রাজ্যের স্বার্থে এবার মোদির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল রাজ্যের মানুষ। গত ৩৪ বছরে কোনো দল এত আসন জিতে কর্ণাটকে সরকার গড়তে পারেনি। জনতার রায় ও রোষের তীব্রতা কতখানি, এটা তারই প্রমাণ।

কংগ্রেসের এই জয় কিংবা অন্যদিক থেকে বিজেপির এভাবে পর্যুদস্ত হওয়ার কারণ অনেক। দুই দলের কাছেই কর্ণাটকের জনতা অনেকগুলো বার্তা দিয়ে রাখল। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে এখন থেকেই ভাবতে হবে, তাদের রাজনীতির মাত্রাতিরিক্ত অতিকেন্দ্রিকতা কোথায় কাজে দেবে, কোথায় অকার্যকর।

ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকে কংগ্রেসে ‘হাইকমান্ড কালচার’ শুরু হয়েছিল। সেই থেকে করগোনা কয়েকজনের সিদ্ধান্তই হয়ে ওঠে প্রথম ও শেষ কথা। কংগ্রেসের সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি আজকের মোদি-শাহ নেতৃত্বাধীন বিজেপিকে গ্রাস করেছে। সেই অর্থে বিজেপির ‘কংগ্রেসায়ন’ ঘটে গেছে দ্রুত। এই অতিকেন্দ্রিকতার মাশুল কর্ণাটকে বিজেপিকে গুনতে হলো।

আরও পড়ুন

অথচ কংগ্রেস হেঁটেছে ঠিক তার উল্টো পথে। কালের নিয়মে কংগ্রেস দুর্বল হয়েছে। হাইকমান্ডের ধার ও ভার—দুই–ই কমেছে বিপুলভাবে। কিন্তু তবু ব্যবস্থাটা রয়ে গেছে। এই প্রথম দেখা গেল, কর্ণাটকে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব জবরদস্তি কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি। প্রচারে প্রথম থেকেই এগিয়ে রেখেছে রাজ্য নেতাদের। রাহুল-প্রিয়াঙ্কারা প্রচার করেছেন অবশ্যই। তাঁদের প্রচারে মানুষ বিপুল সাড়াও দিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মল্লিকার্জুন খাড়গে, সিদ্দারামাইয়া ও শিবকুমাররা দ্যুতি হারাননি। তার ফলও মিলেছে হাতেনাতে।

ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ নমুনা বি এস ইয়েদুরাপ্পা। যে মানুষটি এই রাজ্যে বিজেপিকে শূন্য থেকে গড়ে তুলেছেন, যাঁর নামে প্রভাবশালী লিঙ্গায়েত সমাজ সমর্থনের ডালি বিজেপিকে উজাড় করে দিয়ে এসেছে, যাঁকে দল থেকে তাড়ানোর মাশুল অতীতে বিজেপিকে গুনতে হয়েছে, সেই কারণে যাঁকে দলে ফেরত নিয়ে মুখ্যমন্ত্রিত্ব সঁপে দিতে বাধ্য হয়েছিল বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব, সেই ইয়েদুরাপ্পাকে কোণঠাসা করে মোদি-শাহ এবার কী পেলেন? কংগ্রেস ৪৬ জন লিঙ্গায়েতকে প্রার্থী করেছিল। তাঁদের মধ্যে ৩৭ জন জিতেছেন। নরেন্দ্র মোদি ভেবেছিলেন তিনি অজেয়। কর্ণাটক তাঁকে ভুল প্রমাণিত করল।

‘সবকা সাথ সবকা বিকাশের’ কথা বললেও মোদির দিকে মুখ তুলে তাকায়নি রাজ্যের উপজাতি সমাজ। ১৫টি সংরক্ষিত আসনের একটিও বিজেপি এবার জিততে পারেনি। তফসিল জাতির জন্য সংরক্ষিত ৩৬টি আসনের মধ্যে জিতেছে মাত্র ১২টিতে। মোদি-শাহর হিজাব-হালাল-আজান-আমিষ, টিপু-সাভারকর কিংবা মুসলমানদের জন্য ৪ শতাংশ সংরক্ষণ তুলে দেওয়ার রাজনীতি মুসলমান সমাজকে কংগ্রেসের পেছনে জোটবদ্ধ করে দিয়েছে। দক্ষিণ কর্ণাটকের বিস্তীর্ণ এলাকার মুসলমানরা এত বছর জেডিএস ও কংগ্রেসকে সমর্থন করে গেছেন। এই প্রথম জেডিএসের থেকে মুখ ঘুরিয়ে তাঁরা বেছে নিয়েছেন কংগ্রেসকে। যার ফলে দক্ষিণ কর্ণাটকের ৬৪টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ঘরে তুলেছে ৪৪টি। এটাও এক শিক্ষা।

আরও পড়ুন

রাহুল গান্ধীর আত্মশ্লাঘা হতেই পারে। ৯ মাস আগে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ শুরু করে তিনি বলেছিলেন, ‘ঘৃণার বাজারে ভালোবাসার দোকান খুলতে এসেছি।’ কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর, ১২ রাজ্যের সর্বত্র তিনি ভালোবাসা ও সম্প্রীতির কথা শুনিয়ে গেছেন। কর্ণাটক জয় ঘৃণার রাজনীতির বিপ্রতীপে ভালোবাসাকেই প্রতিষ্ঠিত করল। টানা ২১ দিন ধরে ভারত জোড়ো যাত্রায় অন্য যাত্রীদের সঙ্গে রাহুল কর্ণাটকে হেঁটেছিলেন। সেই যাত্রা মোট ৭টি জেলার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল—বেলারি, চামারাজানগর, চিত্রদূর্গ, মান্ডিয়া, মাইসুরু, রায়চূড় ও টুমকুরু।

এই ৭ জেলায় মোট ৫১টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে কংগ্রেস জিতেছে ৩৭টিতে। ৫ বছর আগে ২০১৮ সালে এই জেলাগুলোয় তারা জিতেছিল মাত্র ১৮টি আসন। গত শনিবার আনন্দিত ও গর্বিত রাহুল তাই বলেছেন, ‘কর্ণাটকে ঘৃণার বাজার বন্ধ হয়েছে, ভালোবাসার দোকান খুলে গেছে।’

শুধু শিক্ষামন্ত্রী বি সি নাগেশ নন, কর্ণাটক অনেককে অনেক রকমভাবে শিক্ষা দিল।