আমেথি থেকে সরে শেষ মুহূর্তে কেন রায়বেরেলি থেকে প্রার্থী হচ্ছেন রাহুল
দীর্ঘ জল্পনার পরে অবশেষে ভারতের শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেস দল তাদের বরাবরের নিরাপদ আসন হিসেবে পরিচিত উত্তর প্রদেশ রাজ্যের রায়বেরেলি এবং আমেথি আসনে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে। এবার লোকসভা নির্বাচনে রায়বেরেলি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন দলের মুখ রাহুল গান্ধী এবং পাশের আসন আমেথি থেকে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে গান্ধী পরিবারের বিশ্বস্ত অনুগামী কিশোরীলাল শর্মা।
কিশোরীলাল শর্মাকে ওই দুই আসনে গান্ধী পরিবারের ম্যানেজার বলে সাধারণ মানুষ চিহ্নিত করেন। অতীতে গান্ধী পরিবারের একাধিক সদস্যের ওই আসনে জয়ের পেছনে তাঁর বড় ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়ে থাকে। ২০ মে পঞ্চম দফায় রায়বেরেলি ও আমেথিতে। ফল ঘোষণা করা হবে ৪ জুন।
একেবারে শেষ মুহূর্তে রায়বেরেলি থেকে রাহুল গান্ধীর নাম ঘোষণা করল কংগ্রেস। আজ শুক্রবারই তিনি মনোনয়নপত্র জমা দেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন তাঁর মা সোনিয়া গান্ধী এবং বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী।
দিল্লি থেকে এক বিশ্লেষক মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এত দেরিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে কী লাভ হলো? আর যদি সিদ্ধান্ত দেরিতে নেওয়া হয়, তবে তার একটা কারণ থাকতে হবে। সেই রকম কোনো কারণ রাহুল বা কংগ্রেস দেখাতে পারেনি।
এই আসন থেকে গান্ধী পরিবারের একাধিক সদস্য অতীতে নির্বাচনে জিতেছেন, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন রাহুল গান্ধীর পিতামহ ফিরোজ গান্ধী, মাতামহ ইন্দিরা গান্ধী এবং মা সোনিয়া গান্ধী। ২০০৪ সাল থেকে একটি উপনির্বাচনসহ পরপর পাঁচটি লোকসভা নির্বাচনে রায়বেরেলি থেকে জিতেছেন সোনিয়া। অতীতে একবার জনতা পার্টি এবং একবার ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) রায়বেরেলি আসন জিতলেও এটিকে গান্ধী পরিবারের নিরাপদ আসন বলে মনে করা হয়।
৫ বছর আগে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পাশের আসন আমেথি থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন রাহুল। হেরেছিলেন এক সময়ের জনপ্রিয় টেলিভিশন তারকা, বিজেপির নেত্রী স্মৃতি ইরানির কাছে। স্মৃতি ইরানি এবারও আমেথিতে বিজেপির প্রার্থী। সম্ভবত সেই কারণেই আমেথি থেকে রাহুলকে সরিয়ে প্রার্থী করা হয়েছে রায়বেরেলিতে।
আমেথিতে দাঁড়িয়েছেন চার দশক ধরে গান্ধী পরিবারের বিশ্বস্ত নেতা কিশোরীলাল শর্মা। আদতে পাঞ্জাবের লুধিয়ানার মানুষ কিশোরীলালকে ১৯৮৩ সালে আমেথিতে প্রার্থী করা হয়েছিল। তাঁকে সেখানে নিয়ে আসেন রাজীব গান্ধী। তখন থেকেই পরিবারের তরফে এই আসন এবং পাশের রায়বেরেলি দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন কিশোরীলাল।
ধারণা করা হয়ে থাকে, ওই অঞ্চলে সামান্য সময় কাটিয়েও সোনিয়া গান্ধীর পরপর পাঁচবার জয়ের পেছনে রয়েছে কিশোরীলালের মস্তিষ্ক এবং পরিশ্রম।
জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের এক সাবেক সাধারণ সম্পাদক আজ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এই দুই আসনে তাঁর ভূমিকার কারণে তাঁকে পুরস্কৃত করা হলো। তবে এটাও ঠিক, দীর্ঘদিন ধরে চিন্তা–ভাবনা করে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কংগ্রেস এই দুই আসনে প্রার্থী নিশ্চিত করতে পারেনি। একদিক থেকে কংগ্রেসকে কিছুটা বাধ্য হয়েও কিশোরীলালকে প্রার্থী করতে হলো।
গতবারের হারের পরে আমেথি থেকে রাহুল গান্ধী দাঁড়াবেন কি না—তা নিয়ে দীর্ঘ জল্পনার পরে তিনি রায়বেরেলিতে সরে যান। স্বাভাবিকভাবেই এটিকে তাঁর সার্বিক পরাজয় হিসেবে ব্যাখ্যা করছে বিজেপি। বিজেপির প্রার্থী স্মৃতি ইরানি আগেই বলেছেন, জেতার ব্যাপারে রাহুল গান্ধীর আত্মবিশ্বাস এতটাই কম যে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
আজ আরও একধাপ এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রায়বেরেলি থেকে রাহুল গান্ধীর দাঁড়ানোর প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি আগেই বলেছিলাম, (কেরালার) ওয়েনাডে পরাজয়ের ভয়ে রাজপুত্র নিজের জন্য অন্য আসন খুঁজছেন। এখন তাঁকে আমেথি থেকে পালিয়ে রায়বেরেলি আসন বেছে নিতে হয়েছে৷ এই নেতারা লোকেরা ঘুরে ঘুরে সবাইকে বলে, ডরো মৎ! ভয় পেয়ো না! আমি তাদের ওই একই কথা বলব, ‘ডরো মৎ! ভাগো মৎ! ভয় পেয়ো না! পালিয়ে যেয়ো না!’
কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতিশীল ও কট্টর বিজেপিবিরোধী বিশ্লেষকরাও এই বিষয়ে রাহুল ও কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্ত। দিল্লি থেকে এক বিশ্লেষক মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দেরিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে কী লাভ হলো? আর যদি সিদ্ধান্ত দেরিতে নেওয়া হয়, তবে তার একটা কারণ থাকতে হবে। সেই রকম কোনো কারণ রাহুল বা কংগ্রেস দেখাতে পারেনি।’
ওই বিশ্লেষক বলেন, একটা সময় পত্রপত্রিকায় কংগ্রেসের নেতাদের উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, রাহুল চান না যে পরিবারের কেউ আমেথি বা রায়বেরেলি থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক। আবার কখনো শোনা গেছে, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বা তাঁর স্বামী রবার্ট ভদ্রের নাম। অর্থাৎ এই দুই আসনের প্রার্থী নিয়ে কংগ্রেসের মধ্যে যে চূড়ান্ত বিভ্রান্তি রয়েছে, তা স্পষ্ট।
এর মধ্যেই রাহুল গান্ধীর নাম ঘোষিত হয়েছে কেরালার ওয়েনাড আসনে, যেখানে কংগ্রেসের শক্তিশালী সংগঠন রয়েছে। স্থানীয় নেতা–কর্মীরাই সেখানে রাহুল গান্ধীর জয় সুনিশ্চিত করবে। তাঁকে বিশেষ কিছু করতে হবে না।
বিশ্লেকেরা বলছেন, কেন এত দিন ধরে গান্ধী পরিবার, কংগ্রেস এবং রাহুল গান্ধী নিজে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না—তা একটা বিস্ময়। এটা প্রমাণ করে, যাঁকে সামনে রেখে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস এই লড়াইয়ে নেমেছে, সেই রাহুল গান্ধীর এখনো প্রবল আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে। সরাসরি না হলেও সব আসনে এর একটা ক্ষুদ্র প্রভাব পড়বে।