সেদিন বালকের জন্য বিক্রি হয়েছিল বালিকা, সংকটে পড়েছিলেন বিচারক

ভারতের বোম্বে শহরে (বর্তমান মুম্বাই) সেদিন এক মামলার রায় নিয়ে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছিল। দাস (গোলাম) হিসেবে মানুষ বেচাকেনার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন দুই ব্যক্তি। তাঁদের মধ্যে একজন ভারতবর্ষের নাগরিক না হওয়ায় তাঁদের শাস্তির সিদ্ধান্ত নিয়ে সংকটে পড়েছিলেন বিচারক।

মহম্মদ আমীন আবদুল রহিম এবং পীর খাঁ হাজি নামে দুজনই ভারতে অন্যান্য পণ্য নিয়ে ব্যবসা করার সময় কেনাবেচা করেছিলেন বালক-বালিকা। আর গোলাম বা দাস হিসেবে মানুষ কেনাবেচার এই মামলা নিয়ে বোম্বের আদালত রায় দিয়েছিলেন ১৮৩৫ সালের ১৩ জুলাই।

১৮৯ বছর আগে সেদিন আদালতে উপস্থিত করা হয় দুই অভিযুক্তকে। মানুষ বিক্রি দণ্ডনীয় অপরাধ তাই জনসচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে সেই খবর প্রকাশিত হয়েছিল ওই বছরের ৮ আগস্টের সমাচার দর্পণ পত্রিকায়। সোয়া চার শ শব্দের এই প্রতিবেদনে বলা হয়, মহম্মদ আমীন আবদুল রহিম ও পীর খাঁ হাজি নামে দুই ব্যক্তি দুজন কাফ্রি বালক-বালিকা বেচাকেনা করেছেন বোম্বের এক উপদ্বীপের শহরে।

বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে, একজন আরব বণিক ওই বালিকাকে মহম্মদ আমীন আবদুল রহিমের কাছে বিক্রি করেন। এরপর তাঁর সঙ্গে বোম্বেতে দেখা হয় কান্দাহার থেকে আসা ব্যবসায়ী পীর খাঁ হাজির। এ সময় আমীন দেখতে পান পীর খাঁর কাছে আগে থেকেই একজন কাফ্রি বালক আছে। সেই বালকের সঙ্গী হিসেবে মহম্মদ আমীন নিজের কাছে থাকা বালিকাটিকে বিক্রি করেন পীর খাঁর কাছে। তখন ভারতবর্ষে মানুষ বেচাকেনার খবর বিরল ঘটনা ছিল না। কিন্তু ১৮৩৫ সালের এই ঘটনাটি নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল কারণ এর মাত্র দুই বছর আগে ১৮৩৩ সালে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করে আইন পাস করেছিল ব্রিটিশ সরকার।

তাই সেদিন কান্দাহারের বণিক পীর খাঁ হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিতে আদালতে উপস্থিত হতে হয়েছিল আরও দুজন আরব বণিককে। এই ঘটনা নথিবদ্ধ হয়েছিল গেজেটে। উঠে এসেছিল পত্রিকায়। সেদিন সাক্ষ্য দিতে আসা দুই আরব বণিক বলেছিলেন, এই ব্যক্তি (পীর খাঁ হাজি) কান্দাহারে অত্যন্ত সম্মানীয় এবং সম্ভ্রান্ত। ব্যবসার জন্য তিনি কান্দাহার থেকে বোম্বাইয়ে এসেছেন। কান্দাহারে তখনো দাস কেনাবেচা নিষিদ্ধ হয়নি। তাই ভারতবর্ষে ইংল্যান্ডের এই নতুন আইন প্রয়োগের কথা তিনি জানেন না।

১৮৩৫ সালের ৮ আগস্ট, বাংলা ১২৪২ সালের ২৪ শ্রাবণ সমাচার দর্পণে প্রকাশিত ‘গোলাম ক্রয় বিক্রয়করণের দণ্ড’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে আসামি পীর খাঁ হাজির সাক্ষ্য দিয়ে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, কান্দাহারে তখন ঘোড়া (অশ্ব) বেচাকেনার মতোই দাস (গোলাম) বেচাকেনা হতো।

এই মামলার রায়ের জন্য কয়েকজন বিচারককে নিয়ে একটি প্যানেল তৈরি করা হয়েছিল। তাঁদের প্রধান ছিলেন সর জন আডরি নামে এক ইংরেজ বিচারক। মামলার বিস্তারিত শোনার পর তিনি বলেন, এই বেচাকেনার ঘটনায় দুই ব্যক্তিই সমানভাবে অপরাধী। তবে তাদের শাস্তি কী হবে তা অন্যান্য সব বিচারকেরা মিলে সিদ্ধান্ত নেবেন।

এরপর বিচারকেরা আদালতে ঘটনাস্থল থেকে আরেক জায়গায় সরে যান। ধারণা করা যায়, তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে এই কাজটি করেন। সমাচার দর্পণে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তেমনই ইঙ্গিত দেওয়া আছে। কিছুক্ষণ পর আদালতের ওই কক্ষে আবার তাঁরা ফিরে আসেন। দুই আসামিকেই দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেন।

এই রায়ে সর জন আডরি ঘোষণা করেন, গোলাম বেচাকেনার জন্য আবদুল আমীনের সাত বছর পর্যন্ত  দ্বীপান্তর এবং পীর খাঁ হাজির তিন বছর কঠিন পরিশ্রম যুক্ত কারাবরণ করতে হবে। আবদুল আমীনকে মরিচ উপদ্বীপে আর কান্দাহারের বাসিন্দা পীর খাঁ হাজি ‘হরিণ বাটি’র কারাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। মানুষ বেচাকেনা করা এই দুই ব্যক্তির এরপর কী ঘটেছিল অথবা সেই কাফ্রি বালক আর বালিকারই বা পরিণতি কী ছিল, তা আর জানার উপায় নেই। তবে ১৩ জুলাই আদালতে এই রায়ের দুই দিন পর ঘটনাটি ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

দুই শ বছর আগে দাস হিসেবে মানুষ বিক্রির এই ইতিহাস ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলজুড়েই ছিল। বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘর, ন্যাশনাল আর্কাইভ, সিলেট জাদুঘর ছাড়াও সিলেট সাবরেজিস্ট্রি অফিসের বালাম বইতে পাওয়া যায় মানুষ বিক্রির এমন দলিল। ২০২২ সালে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে সিলেট সাবরেজিস্ট্রি অফিসের বালাম বই থেকে প্রথমবারের মতো উদ্ধার করা হয় মানুষ বিক্রির এমন তিনটি দলিল। এ নিয়ে ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছিল একটি প্রতিবেদন। যেখানে উল্লেখ রয়েছে মানুষ বিক্রির জন্য একসময় কবলানামা করার নিয়মের কথা।

সেখানে দেখা যায় তৎকালীন ২৮ মণ ধানের দামে আজীবনের জন্য বিক্রি হয়েছে মা ও ছেলে। এই দলিল ৩টি ছিল ১৮০৬ এবং ১৮০৭ সালের। অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকার দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার দুই যুগ আগের ইতিহাস।

তবে ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ সরকার দাস প্রথা বিলুপ্ত করার পরপরই একজন বিদেশি নাগরিকের মানুষ বেচাকেনার ঘটনাটি সেদিন আলোচিত হয়েছিল বোম্বেসহ গোটা ভারতবর্ষেই। তাই বাংলা পত্রিকায় স্থান পেয়েছিল সে খবর। তবে এই প্রচলন যে আরও কিছুকাল ভারতবর্ষে ছিল সে প্রমাণও তখনকার সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন

বোম্বের এই ঘটনার পাঁচ বছর পর ১৮৪০ সালের ১১ জানুয়ারি সমাচার দর্পণে ছাপা হয় আবারও গোলাম বেচাকেনার আরেক খবর। বাংলা ১২৪৬ সালের ২৮ পৌষ প্রকাশিত সেই ছোট্ট সংবাদটিতে লেখা আছে ‘আমরা শুনিলাম যে কলিকাতার একজন জমিদার বারাণস হইতে স্বগৃহে আগমনকালীন ভগলপুরের বাজারে ৪০ টাকা মূল্যে এক গোলাম ক্রয় করিয়া লইয়া আসিয়াছেন। এবং তিনি কহিলেন যে তদ্দিবসে সেই বাজারে দাসদাসী প্রায় ২০/২৫ জন বিক্রয় হইয়াছিল।’ সমাচার দর্পণের এই তথ্যগুলো পাওয়া যাবে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সংকলিত ও সম্পাদিত ‘সংবাদপত্রের সেকালের কথা’-এর দ্বিতীয় খণ্ডের ‘সমাজ’–বিষয়ক সংবাদ সংগ্রহের তালিকায়।