জি-২০ সম্মেলনে ‘বিশ্ব জৈব জ্বালানি জোট’ গঠনের কারণ কী
জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা কমিয়ে জৈব জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে জি-২০–র আসরে বিশ্ব জৈব জ্বালানি জোট গঠিত হলো। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি–২০ শীর্ষ সম্মেলনে গত শনিবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ জোট গঠনের কথা ঘোষণা করেন।
এ জোটের প্রাথমিক লক্ষ্য পেট্রলের সঙ্গে ২০ শতাংশ ‘ইথানল’ মেশানো। এর ফলে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমবে। তাতে দূষণের মাত্রাও কমবে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় কিছুটা সহায়ক হবে। পেট্রলের সঙ্গে ইথানল মেশানোর কর্মসূচি প্রধানমন্ত্রী মোদি আগেই ভারতে গ্রহণ করেছেন। এবার তিনি চান যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অন্য দেশের সহযোগিতায় একযোগে এই কর্মসূচি বৈশ্বিক পর্যায়ে সফল করতে।
প্রধানমন্ত্রী মোদি এই জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভা, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাশে নিয়ে। এই চার দেশ ছাড়া এ জোটে রয়েছে আর্জেন্টিনা, মরিশাস, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আরব আমিরাত। এরা ছাড়া পর্যবেক্ষক দেশ হিসেবে রয়েছে কানাডা ও সিঙ্গাপুর।
সদস্যদেশের নেতা-নেত্রীদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি ওই অনুষ্ঠানে বলেন, ‘দূষণমুক্ত জ্বালানি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে টেকসই উন্নয়ন প্রচেষ্টায় জোট গঠনের এই সন্ধিক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে থাকবে। প্রকৃতি রক্ষায় জ্বালানির মিশ্রণ আজকের দাবি। সেই দাবি পূরণে সবার একজোটে নামা প্রয়োজন। পেট্রলের সঙ্গে ২০ শতাংশ ইথানল মেশানো বিশ্বপর্যায়ে শুরু করা আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য।’
ইথানল তৈরি হয় প্রকৃতিবান্ধব শস্য আখ থেকে। পেট্রল, ডিজেল কিংবা প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার কমানোর ক্ষেত্রে এই ইথানল যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। সদস্যদেশগুলো আখ উৎপাদন বাড়িয়ে সেই পরিবর্তনে সহায়ক হতে পারবে। ভারত বা বাংলাদেশের মতো দেশের অর্থনীতির জন্য এই জোটবদ্ধতা আরও জরুরি, কারণ শক্তি পেতে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা এসব দেশে দিন দিন বেড়ে চলেছে। ইথানল ছাড়াও ভারতে জৈব জ্বালানির আরও কয়েকটি ব্যবস্থার ওপর সরকার জোর দিয়েছে—যেমন গোবর গ্যাস বা কম্পোস্ট জ্বালানি। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দূষণের মোকাবিলার পাশাপাশি কৃষকদের রোজগারও বাড়বে বলে সরকার মনে করে।
মোদি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার সময় মোট প্রয়োজনের ৮০ শতাংশ অশোধিত পেট্রল ও ডিজেল ভারত আমদানি করত। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৮৭ শতাংশ। ২০২২-২৩ সালে ভারতের মোট অশোধিত পেট্রল–ডিজেল আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৫৮ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থ বছরের তুলনায় ৩১ শতাংশ বেশি। ২০১৫ সালে প্যারিসে আন্তর্জাতিক সৌরশক্তি জোট গঠন করেছিল ভারত। লক্ষ্য ছিল পরিচ্ছন্ন শক্তি সবার জন্য সহজলভ্য করা। জৈব জ্বালানি জোট তারই প্রতিবিম্ব।
ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে ‘জিরো এমিশন’ লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে জৈব জ্বালানির উৎপাদন ও ব্যবহার ২০৩০ সালের মধ্যে তিন গুণ বাড়াতে হবে। কাজেই সেই লক্ষ্য পূরণে এ পদক্ষেপ একটা বড় চ্যালেঞ্জ। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল জৈব জীবাশ্মের সবচেয়ে বেশি উৎপাদনকারী দেশ।
জি-২০ প্রধানত অর্থনৈতিক সহযোগিতার মঞ্চ; ভূকৌশলগত কিংবা নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিবাদের মীমাংসার মঞ্চ নয়। কিন্তু উন্নয়ন, টেকসই উন্নয়ন ও প্রগতির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংঘাত প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ফেলে বলে রাশিয়া–ইউক্রেনের যুদ্ধ এ সম্মেলনে একটা বড় পরিসর দখল করে রেখেছে। প্রগতি ও মানবকল্যাণের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলার প্রচেষ্টা তবু হারিয়ে যায়নি। জৈব জ্বালানি ক্ষেত্রে জোটবদ্ধতা তার প্রমাণ। প্রধানমন্ত্রী মোদি এই অবসরে এ কথাও জানান, উন্নত দেশগুলো তার প্রতিশ্রুতি রক্ষায় এবার অনেক বেশি সদর্থক মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় ১০০ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে এই প্রথম সদিচ্ছা প্রকাশ করেছে উন্নত বিশ্ব।
২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে উন্নত বিশ্ব বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। জি-২০ সম্মেলন চলাকালে হোয়াইট হাউস এই প্রসঙ্গে জানিয়েছে, দূষণমুক্ত শক্তি বাইডেন প্রশাসনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।