ভারতে রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ
সংসদীয় ভারতের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত যা ঘটেনি, আজ মঙ্গলবার সেটাই ঘটল। বিরোধী জোট ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড়ের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করা হলো। জোটের সব শরিকের সই করা সেই প্রস্তাব রাজ্যসভা সচিবালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবে সই করেছেন রাজ্যসভার প্রায় ৬০ সদস্য।
নিয়ম অনুযায়ী আলোচনার পর অনাস্থা প্রস্তাব গৃহীত হলে তা নিয়ে ভোটাভুটি হয়। সাধারণ সংখ্যাধিক্যে, অর্থাৎ মোট সদস্যের অর্ধেকের চেয়ে একজন বেশি প্রস্তাব সমর্থন করলে তা গৃহীত হয়। তবে সেই প্রস্তাব তারপর পাঠাতে হয় লোকসভায়। সেখানেও সাধারণ সংখ্যাধিক্যে পাস হলে রাজ্যসভার চেয়ারম্যানকে সরে যেতে হয়। আজ পর্যন্ত কোনো চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কখনো অনাস্থা প্রস্তাব পেশই হয়নি। সেই দিক থেকে দেখলে এটাই প্রথম। ধনখড়ই প্রথম, যাঁর বিরুদ্ধে বিরোধীরা সরাসরি অনাস্থা প্রকাশ করলেন।
অবশ্য প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ, নিয়ম অনুযায়ী, চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করতে গেলে ১৪ দিনের নোটিশ দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে বিরোধীরা প্রস্তাব জমা দিলেন মাত্র ১০ দিন আগে। কেননা, ২০ ডিসেম্বর সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শেষ হচ্ছে। অবশ্য প্রস্তাবটি গৃহীত হলেও তা পাস হতো না। কারণ, রাজ্যসভা ও লোকসভা দুই কক্ষেই সরকার পক্ষের পাল্লা ভারী।
কিন্তু তবু বিরোধীরা প্রস্তাবটি পেশ করলেন এক স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার জন্য। বার্তাটি হলো, চেয়ারম্যান হিসেবে ধনখড় নিরপেক্ষ নন। ধনখড়ের বিরুদ্ধে বিরোধী নেতাদের অভিযোগ, তিনি যে দলের ঊর্ধ্বে, একবারের জন্যও সে প্রমাণ রাখতে পারেননি। আদানি ঘুষ–কাণ্ড, সম্ভল সংঘর্ষ, মণিপুর পরিস্থিতি, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, সংবিধান অবমাননা, গলওয়ান সংঘর্ষ, সীমান্ত পরিস্থিতি, ভারত–চীন সম্পর্ক, পেগাসাস গুপ্তচরবৃত্তি কোনো বিষয়েই বিরোধীদের আলোচনার দাবি তিনি মেনে নেননি। বারবার তিনি বিরোধী স্বর দাবিয়ে দিয়েছেন। প্রবীণ কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিং বলেন, এত পক্ষপাতপূর্ণ চেয়ারম্যান তিনি দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দেখেননি। সরকারপক্ষের সদস্যদের তিনি নিয়মের বাইরে গিয়ে কথা বলতে দেন অথচ বিরোধীদের চুপ করিয়ে রাখেন। তৃণমূল নেত্রী সাগরিকা ঘোষ বলেন, এই সরকার সংসদীয় ব্যবস্থাকেই গলা টিপে হত্যা করেছে। অনাস্থা প্রস্তাব পেশ তারই প্রতিবাদ।
আদানি প্রশ্নে লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিক্ষোভ দেখানো নিয়ে ইন্ডিয়া জোটে কিঞ্চিৎ মতপার্থক্য থাকলেও অনাস্থা জ্ঞাপন নিয়ে ইন্ডিয়া জোট এককাট্টা। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, আম আদমি পার্টি, ডিএমকে, এনসিপি (শরদ পাওয়ার), শিবসেনা (উদ্ধব), আরজেডি, জেএমএমসহ সব শরিক দলের সদস্যরাই প্রস্তাবে সই করেছেন। প্রত্যেকেই বলেছেন, বিজেপি সংসদকে সম্মান করে না। সংবিধানকেও মর্যাদা দেয় না। দলীয় ইচ্ছানুসারে সংসদ চালায়। দুই কক্ষের অধ্যক্ষকে তারা দলীয় দাস করে রেখেছে। অনাস্থা প্রস্তাব দাখিল করা সেই মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। বিরোধী নেতারা বলেন, ‘আমরা জানি প্রস্তাবটি গৃহীত না–ও হতে পারে। তবু তা পেশ করা হয়েছে দেশবাসীকে এটা বোঝাতে যে সভার পরিচালক কতখানি পক্ষপাতদুষ্ট। অগণতান্ত্রিক। দলদাস।’
গতকাল সোমবারের মতো আজও লোকসভা ও রাজ্যসভার অধিবেশন মুলতবি হয়ে যায়। টানা তিন দিন দুই কক্ষের অধিবেশন বানচাল করে দিলেন সরকারপক্ষের সদস্যরাই। ভারতীয় সংসদে এটাও বিরল ঘটনা। আদানি ঘুষ–কাণ্ডসহ বিরোধীদের অন্য দাবির পাল্টা হিসেবে বিজেপি সদস্যরা কংগ্রেস, তাদের নেত্রী সোনিয়া গান্ধী ও রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশনের সঙ্গে মার্কিন ধনকুবের জর্জ সোরসের যোগসাজশ নিয়ে আলোচনার দাবিতে তিন দিন ধরে সরব। তাঁদের অভিযোগ, বিদেশি শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে কংগ্রেস ভারতের বদনাম করে চলেছে। মোদি সরকারকে দুর্বল করতে সচেষ্ট। কংগ্রেসের অভিযোগ, বিরোধীদের ন্যায্য দাবি নস্যাৎ করতে বিজেপি এই মনগড়া অভিযোগ খাড়া করে সংসদ অচল রেখেছে।
বিজেপি অভিযোগ এনেছে, এই চক্রান্তের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রও জড়িত। কেননা, জর্জ সোরেসের সংগঠন ‘ওসিসিআরপি’তে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অর্থসহায়তা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ওই অভিযোগ অসত্য ও ভিত্তিহীন বলে আগেই জানিয়েছে।
চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করার পর এখন দেখার বিষয় যে জগদীপ ধনখড় কীভাবে রাজ্যসভা পরিচালনা করেন। কংগ্রেস সদস্য জয়রাম রমেশ যদিও বলেছেন, তাঁদের প্রতিবাদ ও ক্ষোভ কোনো ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে নয়। প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার বিরুদ্ধে।
কংগ্রেস সংসদ সদস্যরা আজও পার্লামেন্ট ভবন চত্বরে আদানি ঘুষ–কাণ্ড নিয়ে বিক্ষোভ দেখান। প্রথম দিনের বিক্ষোভ ছিল প্ল্যাকার্ড নিয়ে। তারপর হাতে লেখা পোস্টার। এরপর গৌতম আদানির সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির ছবি সাঁটা জ্যাকেট পরে। গতকাল কংগ্রেসিরা মোদি–আদানির মুখোশ পরে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। সংসদ ভবন চত্বরেই মুখোশ পরা মোদি ও আদানির সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। আজ কংগ্রেসিরা বিক্ষোভ দেখান মোদি–আদানির ছবি সাঁটা ঝোলা ব্যাগ নিয়ে। বার্তা, কীভাবে লুটের টাকা দিয়ে ব্যাগ বোঝাই করা হচ্ছে।