যেভাবে কংগ্রেস ও জোটে ‘প্রাণ ফিরিয়েছেন’ রাহুল গান্ধী
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনেক কার্যক্রমের বিরোধিতা করা বহু মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। এবারের নির্বাচনে কংগ্রেসের আসন বেড়ে চার বছর আগের নির্বাচনের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। জোটগতভাবেও এগিয়েছে কংগ্রেস। তাদের ইন্ডিয়া জোটের দখলে এসেছে ২৩৩ আসন, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ইউপিএ জোট পেয়েছিল ৯৪ আসন।
এবার কংগ্রেসের এই ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন রাহুল গান্ধী (৫৩)। ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ ও ‘ভারত জোড়ো নবযাত্রা’র মাধ্যমে কংগ্রেসের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের চাঙা করেছেন। এই দুই যাত্রায় ভারতের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ১০ হাজার কিলোমিটার হেঁটেছেন তিনি। এ সময় বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করেছেন। এ যাত্রায় কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সমর্থকেরাও ছিলেন তাঁর সঙ্গী। এর মধ্য দিয়ে সরাসরি গণমানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয় রাহুল গান্ধীর। আর এটাই তাঁকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছিল।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রচারের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল রাহুল গান্ধীর এই দুই পদযাত্রা। এর মধ্য দিয়ে অতীতের নানা সমালোচনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ভারতের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দলটির এবারের নির্বাচনী লড়াইয়ের প্রধান মুখ হয়ে উঠেছিলেন গান্ধী পরিবারের উত্তরাধিকারী রাহুল গান্ধী।
গতকাল মঙ্গলবার নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর ভারতীয় সংবিধান হাতে নিয়ে ‘গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য’ দেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান রাহুল গান্ধী। দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ভারতের জনগণ সংবিধান ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করেছে। নিজেদের অধিকার রক্ষায় পিছিয়ে পড়া ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোটের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।
বিরুদ্ধ রাজনৈতিক বাস্তবতায় ২০১৪ ও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বড় পরাজয় হয়েছিল কংগ্রেসের। কিন্তু এবারের ফলাফলের মধ্য দিয়ে দলটি পুনরায় জীবন ফিরে পেয়েছে। বলা হচ্ছে, এর আগের দুবারের পুনরাবৃত্তি আর ঘটবে না।
এবার নির্বাচনের প্রচারে জনমুখী বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। এ ছাড়া তরুণ ভোটার টানতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালানোর ক্ষেত্রে নতুন কৌশল নিয়েছিলেন। রাহুল গান্ধীর ‘সুবক্তা’ হওয়ার বিষয়টি এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
রাহুল গান্ধীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এক কংগ্রেস নেতা বলেন, ‘তাঁর বক্তব্যে একটা বিষয় খেয়াল করবেন। কখনোই তিনি (জওহরলাল) নেহরু, ইন্দিরা (গান্ধী) কিংবা রাজীব গান্ধীর নাম নেন না। প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে মাঝেমধ্যে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কথা বলতে দেখা গেলেও, রাহুল সেটা করেন না।’
একসময় বলা হতো, রাহুল গান্ধীর সংস্পর্শে যাওয়াটা কষ্টসাধ্য, কিন্তু সেই অবস্থান থেকেও একেবারে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। কংগ্রেসের সেই নেতা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘রাহুল গান্ধীর বক্তব্যে মূলত সাধারণ মানুষেরাই থাকেন। তিনি সহজে সবার সঙ্গে মিশতে পারেন ও বুকে জড়িয়ে নিতে পারেন। মোদির চেয়ে তিনি কতটা আলাদা, সেটা দেখানোর রাজনৈতিক কৌশলের অংশ তাঁর এসব আচরণ।’
গত বছর মানহানির অভিযোগে করা একটি ফৌজদারি মামলায় গুজরাটের একটি আদালত রাহুল গান্ধীকে অভিযুক্ত করেন। এরপর লোকসভার সদস্যপদ হারান তিনি। এর তিন মাস পর অবশ্য লোকসভার সদস্যপদ আবার ফিরে পান। মূলত এর পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী মোদির সমালোচনা এবং ভারতের সংবিধান ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করার আহ্বানই হয়ে ওঠে রাহুল গান্ধীর বক্তৃতার মূল বিষয়।
গত ২৮ মে এক জনসভায় রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, ‘নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে ভারতের বর্তমান সংবিধান বাতিল এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য অধিকার কেড়ে নেওয়া। চাকরির ক্ষেত্রে তাঁদের বিশেষ সংরক্ষিত অধিকার কেড়ে নিতে চায় এই সরকার। অন্ধভাবে বেসরকারীকরণের কথা বলে সরকারি চাকরি কমানো হচ্ছে। এটা হলো পেছন দরজা দিয়ে সরকারি চাকরি থেকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার কেড়ে নেওয়ার কৌশল।’
এরও আগে গত ২৪ মে মোদি সরকারের নেওয়া ‘অগ্নিপথ’ (সামরিক বাহিনীতে স্থায়ী নিয়োগের পরিবর্তে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ) প্রকল্পের সমস্যা নিয়ে কথা বলেন রাহুল গান্ধী। তিনি বলেন, ‘পদযাত্রার সময় তরুণদের দুর্দশার বিষয়গুলো খুব কাছ থেকে দেখেছি। দেশের সেবা করতে চাওয়া তরুণদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি এসব তরুণ ও সেনাবাহিনীর ওপর জোরপূর্বক এই অগ্নিপথ স্কিম চাপিয়ে দিয়েছেন।’