কলকাতায় অমিত শাহর জনসভায় সেই মতুয়ারা এবার কেন গেল না

পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় জনসভায় জনগণের অভিবাদনের জবাব দিচ্ছেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ২৯ নভেম্বরছবি: এএনআই

দীর্ঘ সময় পরে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় জনসভা করলেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কিন্তু শহরের কেন্দ্রে ধর্মতলায় তাঁর সেই সভায় এবার মানুষের উপস্থিতি বেশ কম। অবস্থা দেখে কিছুটা হতাশ হন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সংক্ষিপ্ত করেন ভাষণ। সভায় প্রশ্ন তোলেন, ‘বাংলার আওয়াজ কোথায় হারিয়ে গেল?’

তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসকে আক্রমণ করে অমিত শাহ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো টাকা নিজেদের পকেটে পুরছেন তৃণমূল নেতা–নেত্রীরা। সেই কারণে তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। তিনি প্রশ্ন করেন, ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টি আসন দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসকে, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে অন্তত ৩৫টি দেবে তো?

আজ বুধবার অমিত শাহর জনসভা দেখে অবশ্য মনে হয়েছে, ৩৫ আসন কেন, ১৮ আসন পাওয়াও বিজেপির পক্ষে মুশকিল হবে। এর অন্যতম প্রধান আজ কিছুটা আঁচ করা যায়। প্রধানত বাংলাদেশ থেকে আসা মূলত নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের ধর্মীয় গোষ্ঠী মতুয়া সমাজের মানুষ শাহর সমাবেশে তেমন একটা আসেননি বলে জনসভায় উপস্থিতি ছিল কম।

মতুয়া সমাজের তরফে বলা হয়, আগামী নির্বাচনে বিজেপিকে আর সমর্থন দেওয়া যাবে না। প্রধানত এই মতুয়া সমাজের সমর্থনেই ২০১৯ সালের লোকসভা এবং ২০২১ সালের বিধানসভায় ভালো ফল করেছিল বিজেপি।

এবার মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ বিজেপি সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। এর প্রধান কারণ, ২০১৯ সালে ভারতের নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়ন করে মতুয়া সম্প্রদায়কে পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও গত প্রায় পাঁচ বছরেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি বিজেপি সরকার।

এরই মধ্যে আবার গত রোববার মতুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সদর দপ্তর উত্তর ২৪ পরগনা ঠাকুরনগরে রাস পূর্ণিমা উপলক্ষে মতুয়াদের একটি ধর্মসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয়কুমার মিশ্র বলেন, সর্বভারতীয় মতুয়া মহাসংঘের ইস্যু করা পরিচয়পত্র মতুয়াদের জন্য ‘অস্থায়ী সমাধান’ হিসেবে কাজ করবে।

মিশ্র বলেন, ‘আমি জানতে পেরেছি, ভ্রমণের সময় আপনাদের মধ্যে অনেকেই সমস্যা ও অসুবিধার মুখে পড়েন। কেউ যদি আপনাকে জিজ্ঞাসা করে আপনি কোথায় থাকেন, তাহলে এমন পরিস্থিতিতে আপনাকে কোন কার্ড দেখাতে হবে? কেউ কখনোই আপনাকে প্রশ্ন করতে পারবে না, যদি আপনি অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসংঘের দেওয়া কার্ড দেখান।’

মিশ্র আরও বলেন, ‘ভারত সরকার আপনার সমস্যার স্থায়ী সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছে। (বিজেপির বনগাঁর সাংসদ) শান্তনু ঠাকুরও আপনার সমস্যার সমাধান করতে কঠোর লড়াই করছেন। কিন্তু যতক্ষণ না সমস্যার সমাধান হচ্ছে, ততক্ষণ মহাসংঘের দেওয়া কার্ড ব্যবহার করুন।’

পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্বের পরিবর্তে মতুয়া মহাসংঘের দেওয়া কার্ডকে নাগরিকত্ব প্রমাণপত্র হিসেবে দাখিল করে ভারতীয় প্রমাণের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এই উপদেশে ক্ষুব্ধ হয়েছেন মতুয়ারা।

মতুয়া সম্প্রদায়ের সদস্য ও নদীয়া জেলার হরিণঘাটা বিধানসভার বিজেপি বিধায়ক অসীম সরকার প্রতিমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় গণমাধ্যমকে বলেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ‘ভাঁওতাবাজি শুরু করেছেন।’

অসীম সরকার বলেন, শান্তনু ঠাকুরের নেতৃত্বে মহাসংঘের জারি করা পরিচয়পত্রটিকে কেবল ‘ধর্মীয় পরিচয়পত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। এটি কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। কার্ডটি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কোনো স্বীকৃতি পায়নি। যদি বিজেপি নেতারা এ ধরনের মিথ্যাচার করেন, মানুষ তাঁদের ক্ষমা করবে না।

তবে অমিত শাহ বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়নের বিরোধিতা করলেও বিজেপি এই আইন অবশ্যই বাস্তবায়ন করবে।

নাগরিকত্ব ও এ–সংক্রান্ত আইন নিয়ে গবেষণারত সমাজকর্মী মানিক মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব আইনে নাগরিকত্ব দেওয়ার কোনো কথা নেই। অতএব বিজেপি এই আইনে কোনো দিনই নাগরিকত্ব দিতে পারবে না।

মানিক মণ্ডল বলছেন, এই আইনে বলা আছে, তিনটি দেশের ছয়টি ধর্মের মানুষ, যারা ২০১৪ সালের আগে ভারতে ঢুকেছে এবং পাসপোর্ট ও ফরেন অ্যাক্টে ছাড় পেয়েছে, তারা ‘অবৈধ’ নয়। এই ছাড় এক অর্থে কেউই পায়নি। কারণ, উদ্বাস্তুরা কেউই জানতেন না, এমন কোনো আইন হয়েছে দেশে। কারণ, আইনটা হয়েছে ২০১৯ সালে। আর ছাড় দেওয়া হয়েছে ২০১৪ সালের আগে যাঁরা ধর্মীয় নির্যাতনের কারণে ভারতে ঢুকে সরকারের কাছে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছিলেন, তাঁদের। স্বরাষ্ট্র দপ্তরের হিসাবে, ভারতে এমন ছাড় পাওয়া মানুষের সংখ্যা মাত্র ৩১ হাজার ৩১৩। বাংলায় এমন মানুষের সংখ্যা মোট ১৪৭।

সব মিলিয়ে জনগণ জেনে যাচ্ছে, আইনটি হয়েছে মূলত বৈধ শরণার্থী আর অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নির্বাচনের লক্ষ্যে।

সংবিধান ও আইন অনুযায়ী, ভারতে মোট দুই ধরনের মানুষ বসবাস করেন—নাগরিক আর অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। ভারতের আইনে উদ্বাস্তু বা শরণার্থীর কোনো অস্তিত্ব নেই। আর যারা আন্তর্জাতিক আইনে এ দেশের শরণার্থী, তারা নিজের দেশে ফিরে যাবে। যেমন তিব্বতি, হাজং, পাকিস্তানি, আফগান, রোহিঙ্গা ইত্যাদি। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে এসে বসবাস করা মানুষ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী।

এ অবস্থায় মতুয়ারা ক্রমে আতঙ্কিত হয়ে উঠছে। তারা বুঝে গেছে, বিজেপি তাদের এই আইনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলে পুরোপুরি ভাঁওতা দিয়েছে। সেই কারণেই আজকের অমিত শাহর জনসভায় মতুয়াদের চোখে পড়েনি।