ভারতে টানেলে আটকে পড়া শ্রমিকদের মনোবল কমছে, উদ্ধার কবে এখনো অজানা
টানা নয় দিন পার হচ্ছে অথচ এখনো কেউ জানে না, ভারতের উত্তরাখন্ডের পাহাড়ে নির্মাণাধীন সিলকিয়ারা বেন্ড-বারকোট টানেল বা সুড়ঙ্গে ভূমিধসে আটকে পড়া ৪১ শ্রমিককে কবে উদ্ধার করা যাবে। শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, উদ্ধারে বিলম্ব হওয়ার দরুন তাঁদের মনোবল ক্রমে ভেঙে যাচ্ছে।
একই কথা উত্তরাখন্ডের মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আজ সোমবার বলেছেন, শ্রমিকদের মনোবল অটুট রাখতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামিকে ফোন করে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, উদ্ধারকাজে নতুন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
১২ নভেম্বর ওই টানেলের একাংশ ধসে যায়। টানেলের মুখ থেকে ২০০ মিটার ভেতরে ওই দুর্ঘটনায় আটকে পড়েন ৪১ শ্রমিক। পাইপ মারফত টানেলে অক্সিজেন, পানি ও খাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা দ্রুত করা হলেও আটকে পড়া শ্রমিকদের এখনো বের করে আনা সম্ভব হয়নি।
আজ সোমবার কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, পাঁচটি সংস্থা পাঁচ রকমভাবে উদ্ধারকাজ শুরু করেছে। তিন দিক দিয়ে সুড়ঙ্গ খোঁড়া হচ্ছে, যাতে আটকে পড়া শ্রমিকদের কাছে দ্রুত পৌঁছানো যায়। বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন (বিআরও) ছাড়া অন্য কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলো হচ্ছে অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশন (ওএনজিসি), সাতলেজ জলবিদ্যুৎ নিগম, রেল বিকাশ নিগম লিমিটেড, ন্যাশনাল হাইওয়েজ অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন লিমিটেড এবং তেহরি হাইড্রো ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন লিমিটেড। এ ছাড়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর নির্মাণ শাখার জওয়ানরাও উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছেন।
এসব সংস্থার প্রধান কাজ বিভিন্ন দিক দিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করে আটকে পড়া শ্রমিকদের কাছে পৌঁছানো, যাতে পর্যাপ্ত খাদ্য, পানীয় ও অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়া যায় এবং উদ্ধারকাজ সহজ হয়।
উদ্ধারের জন্য প্রাথমিকভাবে ধসের মধ্য দিয়ে সমান্তরালভাবে একটি ৩ ফুট ব্যাসার্ধের পাইপ ড্রিল করে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে যার মধ্য দিয়ে শ্রমিকেরা হামাগুড়ি দিয়ে ২০০ মিটার পথ অতিক্রম করে বেরিয়ে আসতে পারবেন। সরকারিভাবে বলা হয়েছে, শ্রমিকদের মনোবল দৃঢ় রাখতে সর্বদা তাঁদের সঙ্গে ওয়াকিটকি মারফত কথা বলা হচ্ছে। শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরাও তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলছেন।
কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহনমন্ত্রী নীতীন গড়কড়ি ও মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি গত রোববার টানেলের মুখে যান এবং উদ্ধারকাজ তদারক করেন। গড়কড়ি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, জীবিত অবস্থায় প্রত্যেক শ্রমিককে উদ্ধার করা তাঁদের প্রাথমিক লক্ষ্য। তিনি বলেন, নতুন যন্ত্রপাতি আনার জন্য বিআরও দ্রুত রাস্তা মেরামত করছে। সবকিছু ঠিকমতো এগোলে আশা করা যায়, আগামী দু–তিন দিনের মধ্যে আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধার করা যাবে।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, উদ্ধারের পর শ্রমিকদের পুনর্বাসনে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। এ অবস্থায় এত দিন কাটানোয় তাঁদের শরীর ও মনের ওপর ভয়ংকর চাপ পড়বে। তা থেকে বেরিয়ে আসতে তাঁদের পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে।
হিমালয়ের কোলে পাহাড়ি রাজ্য উত্তরাখন্ডের চার হিন্দু তীর্থক্ষেত্র হলো কেদারনাথ, বদ্রিধাম, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী। এই চার তীর্থক্ষেত্র ওই রাজ্যের চার প্রধান ধাম বা স্থান। নরেন্দ্র মোদি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর হিন্দুত্ববাদের প্রসারের মাধ্যমে হিন্দুমন জিততে ওই চার তীর্থক্ষেত্রে সহজে যাতায়াতের জন্য সড়কব্যবস্থা উন্নত করার সিদ্ধান্ত নেন।
গৃহীত হয় ‘চার ধাম মহামার্গ (সড়ক) প্রকল্প’। ২০১৬ সালে মোট ১২ হাজার কোটি রুপি খরচ করে এই প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। চার ধাম প্রকল্পের কাজ চলাকালে ২০২০ সালে ঘটে যায় পূর্ব লাদাখের গলওয়ানে ভারত-চীন সেনা সংঘর্ষ।
তার পর থেকে তীর্থের পাশাপাশি চীন সীমান্ত নিরুপদ্রব করা, একেবারে সীমান্ত পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য অতিরিক্ত নির্মাণ কর্মসূচিও গৃহীত হয়। তা করতে গিয়ে প্রবলভাবে প্রকৃতির ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা বিভিন্ন মহলে দেখা দেয়। পরিবেশবিদেরা আপত্তি জানান। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকে হিমালয়কে রক্ষা করতে তা অক্ষত রাখার প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠতে থাকে।
বিষয়টি শেষ পর্যন্ত ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যায়। সর্বোচ্চ আদালত দেশের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি প্রকৃতির দিকে খেয়াল রাখার বিষয়ে গুরুত্ব দেন। কিন্তু নানাবিধ নির্মাণকাজের দরুন ছোট-বড় বিপর্যয় সেই থেকে ঘটেই চলেছে। এই সুড়ঙ্গধসও উন্নয়নের নামে মাত্রাছাড়া পরিবেশ নষ্টের কারণ বলে পরিবেশবিদেরা মনে করছেন।
ধসের কারণে টানা নয় দিন ধরে যে সুড়ঙ্গে ৪১ শ্রমিক বন্দী, সেই সিলকিয়ারা বেন্ড-বারকোট টানেল তৈরির সম্মতি কেন্দ্রীয় সরকার অনুমোদন করেছিল ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
১ হাজার ৩৮৪ কোটি রুপির এ প্রকল্প ২০২২ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। সাড়ে চার কিলোমিটার দীর্ঘ এই টানেল শেষ হলে সারা বছরই যমুনোত্রী যাওয়া-আসা করা যাবে। বরফের জন্য রাস্তা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি থাকবে না। তা ছাড়া সেই সময় সরকারি যুক্তি ছিল, এই সুড়ঙ্গ তৈরি হলে ওই অঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারজুড়ে পাহাড়ের অগুনতি গাছ বাঁচবে, রাস্তা করতে গেলে যা কাটতে হতো।