গুলবদন বেগম: সাহসী এক মোগল রাজকন্যার গল্প

গুলবদন বেগম মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের মেয়েছবি: টুইটার থেকে সংগৃহীত

১৫৭৬ সালের শরতের একদিনে মোগল সাম্রাজ্যের সাহসী এক রাজকন্যা রাজপরিবারের একদল নারীকে নিয়ে পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনার উদ্দেশে নজিরবিহীন যাত্রা করেছিলেন। এটাই ছিল কোনো মোগল নারীর প্রথম হজযাত্রা।

এই সাহসী রাজকন্যা হলেন গুলবদন বেগম। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের মেয়ে। গুলবদনের বয়স তখন ৫৩ বছর। তিনি ফতেহপুর সিক্রি (বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি শহর) থেকে ১১ জন নারীকে নিয়ে মক্কা–মদিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন।

তবে ইতিহাসবিদদের অনেকে মনে করেন, বিভিন্ন ঐতিহাসিক নথিতে গুলবদনের এই অসাধারণ যাত্রার বিস্তারিত বিবরণ নেই। তাঁদের ধারণা, ‘শালীনতা ও পবিত্রতা’ রক্ষা করার নাম করে রাজপরিবারে নিযুক্ত পুরুষ ইতিহাসবিদেরা নারীদের এই হজযাত্রার বিভিন্ন তথ্য বাদ দিয়েছেন।

গুলবদনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইতিহাসবিদ রুবি লালের লেখা ‘ভ্যাগাবন্ড প্রিন্সেস: দ্য গ্রেট অ্যাডভেঞ্চারস অব গুলবদন’ বইয়ে এসব তথ্য স্থান পেয়েছে। চলতি মাসের শেষের দিকে বইটি প্রকাশ হওয়ার কথা। বইতে রুবি লাল লিখেছেন, মক্কা–মদিনার উদ্দেশে গুলবদনের ওই যাত্রা যে কেবল সাহসিকতা ও উদারতায় ভরা ছিল, তা–ই নয়, ছিল বিদ্রোহও।

গুলবদনকে মোগল সাম্রাজ্যের প্রথম এবং একমাত্র নারী ইতিহাসবিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মোগল সম্রাট হুমায়ুনের জীবনী নিয়ে তিনি ‘হুমায়ুননামা’ লিখেছেন। তাতে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো লিখলেও নিজের ওই ভ্রমণের তথ্য তিনি দেননি। এমনকি সে বইটি অসম্পূর্ণ, বইটির কয়েকটি পৃষ্ঠাও নেই।

সম্রাট বাবরের কন্যা গুলবদন

সম্রাট বাবরের কন্যা গুলবদনের জন্ম ১৫২৩ সালে, কাবুলে। তাঁর মা দিলদার বেগম। গুলবদনের জন্মের সময় বাবা ছিলেন অনেক–অনেক মাইল দূরে। তিনি তখন হিন্দুস্তান (তখন ভারতীয় উপমহাদেশ এ নামে পরিচিত ছিল) জয়ের পরিকল্পনা করছিলেন। বিভিন্ন যুদ্ধে ব্যস্ত থাকা বাবর মাঝেমধ্যে কিছু সময়ের জন্য যখন ফিরতেন, তখন বাবার সঙ্গে দেখা হতো গুলবদনের।

সম্রাট বাবর আগ্রা জয় করার পর গুলবদন কাবুল থেকে আগ্রা যান। তখন তাঁর বয়স ছিল ছয় বছর। তিনি ছিলেন কাবুল থেকে আগ্রা যাওয়া প্রথম মোগল মেয়েশিশু। বিয়ের আগে তিনি আর কাবুলে ফিরে যাননি। আফগান রাজা শের শাহ সুরি তাঁর পরিবারকে ‘হিন্দুস্তান’ থেকে বিতাড়িত করার পর তাঁরা কাবুলের উদ্দেশে যাত্রা করেন। এ যাত্রা শেষ হতে কয়েক মাস লেগেছিল। গুলবদনসহ রাজপরিবারের অন্য নারী সদস্যরা পথে তাঁবুতে থেকেছেন, পালকি ও ঘোড়ার পিঠে চড়ে নির্জন পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়েছেন, সাহসিকতার সঙ্গে শত্রু, চোর ও অন্য প্রতিবন্ধকতাগুলোর বিরুদ্ধে লড়েছেন।

রুবি লাল বলেন, ‘মোগল নারীরা ভবঘুরে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁদের প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জায়গায় যেতে হতো। যুদ্ধক্ষেত্রে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে গেলে তাঁরা অস্থায়ী শিবিরে থাকতেন।’

রুবি লাল মনে করেন, এ ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কারণেই হয়তো মোগল রাজকন্যা গুলবদন বেগম হজের জন্য যাত্রা করার সাহস পেয়েছিলেন। ১৫ শতকের শেষের দিকে তিনি তাঁর ভাতিজা সম্রাট আকবরের কাছে হজে যাওয়ার অনুমতি চান।

ইতিহাসবিদ রুবি লাল তাঁর বইতে লিখেছেন, আকবরের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ছিল মোগল রাজবংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। তিনি তাঁর এ লক্ষ্য পূরণে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি নিজেকে পবিত্র ব্যক্তিত্ব, আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনিই প্রথম মোগল শাসক, যিনি মোগল নারীদের হারেমের ভেতর থাকার আদেশ দিয়েছিলেন। যেখানে সম্রাট ছাড়া কারও যাওয়ার অনুমতি ছিল না।

মক্কা যাত্রা

বাঁধাধরা জীবনযাপন গুলবদনকে অস্থির করে তুলেছিল। আর সে কারণেই হয়তো ১৫৭৬ সালের অক্টোবরে তিনি এবং রাজপরিবারের অন্য নারীরা মক্কায় হজের জন্য যাত্রা শুরু করেন। তিনি সম্রাট আকবরকে বলেছিলেন, এটা সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁর অঙ্গীকার।

আকবরের দেওয়া ‘সালিমি’ ও ‘ইলাহি’ নামের দুই জাহাজে করে ওই নারীরা হজযাত্রা শুরু করেন। দান-খয়রাতের জন্য রাজকীয় দলটির সঙ্গে ছিল সোনা, রুপা, হাজার হাজার নগদ অর্থ এবং ১২ হাজার পোশাক।

তখন মক্কায় যাওয়ার নৌপথ ছিল পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রণে। তারা মুসলিমদের জাহাজ পেলেই লুটপাট চালাত, আগুন দিত। গুলবদন এবং তাঁর সঙ্গীরা প্রায় এক বছর ধরে সুরাট বন্দরে আটকা ছিলেন। নৌপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পর যাত্রা করেন তাঁরা। চার সপ্তাহ পর তাঁরা আরব সাগর হয়ে জেদ্দা পৌঁছাতে সক্ষম হন। এর পর তাঁরা কয়েক দিন ধরে উটের পিঠে চড়ে তপ্ত মরুপথ পাড়ি দিয়ে পবিত্র নগরী মক্কায় পৌঁছান।

বিদ্রোহী গুলবদন

মক্কা সফরের পর গুলবদন এবং তাঁর সঙ্গীরা পরবর্তী চার বছর আরবেই থেকে যান। রুবি লাল লিখেছেন, যেভাবে তাঁরা (গুলবদন ও সঙ্গীরা) সবাই মিলে হারেম ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, একইভাবে তাঁরা সবাই মিলে মরুময় ওই ভূখণ্ডে যাযাবরের জীবন বেছে নেন। গুলবদন এবং তাঁর সঙ্গীরা যে মুদ্রা ও অন্যান্য জিনিস দান-খয়রাত করছেন, তা শহরটিতে রটে যায়। মোগল রাজকন্যার দানশীলতা ক্ষমতাসীন অটোমান সুলতান মুরাদকে ক্ষুব্ধ করেছিল। তিনি এই কাজগুলোকে আকবরের রাজনৈতিক শক্তি দেখানোর প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছিলেন।

এরপর গুলবদন ও মোগল নারীদের আরব থেকে বিতাড়িত করার জন্য সুলতান মুরাদ তাঁর কর্মীদের নির্দেশ দেন। তিনি তিন দফায় এ আদেশ জারি করেছিলেন। তবে গুলবদন প্রতিবারই আরব ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান।

ইতিহাসবিদ রুবি লাল লিখেছেন, এটি কোনো মোগল নারীর বিদ্রোহ করার নজিরবিহীন ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, নিজের স্বাধীনতার জন্য গুলবদনের কতটা আকাঙ্ক্ষা ছিল।

ফতেহপুর সিক্রির হারেমের একটি অংশ, যা বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত
ছবি: টুইটার থেকে সংগৃহীত

অবশেষে তাঁর (গুলবদন) একগুঁয়েমিতে বিচলিত হয়ে সুলতান মুরাদ ওই নারীদের বিরুদ্ধে অটোমান তুর্কি ভাষায় নিন্দাসূচক (ব্যববহার অনপুযুক্ত) শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। আর এতে সম্রাট আকবর অসন্তুষ্ট হন।

গুলবদনের ফেরা

১৫৮০ সালে সুলতান মুরাদের ওই আদেশ জারির পর গুলবদন এবং তাঁর সঙ্গীরা আরব ছেড়ে যান। তাঁরা ১৫৮২ সালে ফতেহপুর সিক্রি থেকে ৬০ কিলোমিটার পশ্চিমে খানওয়াতে পৌঁছান।

ফেরার পর গুলবদনকে ‘নবাব’ (শাসক) হিসেবে প্রশংসা করা হয়। এমনকি সম্রাট আকবর ‘আকবরনামা’ গ্রন্থের লেখকদের মধ্যে একমাত্র নারী হিসেবে তাঁকে যুক্ত করেন।

তবে আকবরনামার একটি অধ্যায়ের পুরোটাজুড়ে গুলবদনের মক্কা ভ্রমণের কথা থাকলেও আরবে তাঁর কাটানো সময় এবং সুলতান মুরাদের প্রসঙ্গ সেখানে বা অন্য কোথাও উল্লেখ নেই।