২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

স্কুল থেকে ঝরে পড়া আদানি যেভাবে ভারতের ধনকুবের

গৌতম আদানি
ফাইল ছবি: রয়টার্স

পড়ালেখা শুরুতে তাঁর খুব একটা হয়নি। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান হয়েও স্কুল থেকে ঝরে পড়েছিলেন। ছিল অর্থকষ্টও। এই সংকট কাটাতে ব্যবসার নেশা পেয়ে বসে তাঁর। একদিন সেই স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুটি এখন ভারতের শীর্ষ ধনকুবের ও এশিয়ার শীর্ষ ধনীদের একজন। তিনি আদানি গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান গৌতম আদানি।

বিবিসি অনলাইন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গৌতম আদানির ধনকুবের হওয়ার পথ খুব সহজ ছিল না। নানা সংগ্রাম করে তাঁকে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। এসব আলোচনার অনেক কিছুই অনেকের জানা। তবে সম্প্রতি গৌতম আদানি ভারতে বেসরকারি টেলিভিশন নিউজ চ্যানেলের পথিকৃৎ নিউ দিল্লি টেলিভিশন বা ‘এনডিটিভি’ কিনে আবারও নতুন করে আলোচনায় এসেছেন।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে স্কুলের লেখাপড়া থেকে ছিটকে পড়েন আদানি। এরপর তিনি ব্যবসায় হাত পাকানোর জন্য মুম্বাই চলে যান। সেখানে হীরার ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু এই ব্যবসায় সুবিধা করতে না পেরে দুই বছর পর আবার নিজের রাজ্য গুজরাটে ফিরে আসেন। এখানে তাঁর ভাইয়ের একটি প্যাকেজিং কারখানায় কাজ শুরু করেন।

আদানির মধ্যবিত্ত পরিবারের আয়ের উৎস ছিল কাপড়ের ব্যবসা। ১৯৯৮ সালে তিনি নানা পণ্যের ব্যবসার উদ্দেশ্যে একটি ফার্ম চালু করেন। এরপর তাঁকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। পরবর্তী ২৪ বছর জ্বালানি ব্যবসা পেরিয়ে দেশটির বন্দর, খনি, রেলপথ, অবকাঠামো, বিদ্যুৎ এবং রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় তিনি অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছেন। এখন তাঁকে ভারতের নতুন প্রজন্মের ধনকুবের হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ফাইল ছবি: রয়টার্স

ধনকুবের হওয়ার এই পথ মোটেও তাঁর জন্য মসৃণ ছিল না। একবার তিনি প্রায় মরতে বসেছিলেন। ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর রাতের ঘটনা। সে সময় ভারতের শীর্ষ ১০তম ধনকুবের গৌতম আদানি বিলাসবহুল তাজমহল হোটেলে রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলেন। সেই রাতে ১০ বন্দুকধারী ওই হোটেলে ঢুকে এলোপাতারি গুলি ও গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। বন্দুকধারীরা সবাই পাকিস্তানের নাগরিক ছিলেন। ওই ঘটনায় ১৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

পরে আদানি ইন্ডিয়া টুডে ম্যাগাজিনকে বলেছিলেন, সেই দিন হোটেলের কর্মীরা দ্রুত কয়েক ঘণ্টার জন্য তাঁদের বেসমেন্টে লুকিয়ে রেখেছিলেন। যখন আবার তাঁদের ওপরের হলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখনো হামলা চলছিল। হলটিতে প্রায় ১০০ অতিথি ছিলেন। কেউ কেউ সোফার নিচে লুকিয়ে প্রাণরক্ষার জন্য প্রার্থনা করছিলেন। সেদিন তাঁরা পুরো রাত হোটেলে আটকা ছিলেন। পরদিন সকালে কমান্ডোরা হোটেল ঘিরে ফেললে পেছনের দরজা দিয়ে তাঁদের বের করে আনা হয়।

আরও পড়ুন

পরে ব্যক্তিগত বিমানে আহমেদাবাদে ফেরার পর সাংবাদিকদের আদানি বলেছিলেন, ‘সেদিন আমি ১৫ ফুট দূরত্বে আমার মৃত্যু দেখেছিলাম।’ এ ঘটনার প্রায় ১৪ বছর পর ইলন মাস্ক ও জেফ বেজোসের পেছনে বিশ্বের তৃতীয় ধনীর স্বীকৃতি পেয়েছেন ৬০ বছর বয়সী আদানি।

১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে আহমেদাবাদে বন্দুক ঠেকিয়ে আদানি ও তাঁর সহযোগীকে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করা হয়েছিল।

বর্তমানে ভারতের অবকাঠামো খাতের মোগল হিসেবে পরিচিত হয়ে আছেন আদানি। ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিমেন্ট কোম্পানির মালিক তিনি। তিনি দেশটির পশ্চিম উপকূলীয় শহর মুন্দ্রাতে দেশের বৃহত্তম ও সাতটি বিমানবন্দরসহ ১৩টি বন্দরসহ পরিচালনা করেন। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী দিল্লি ও মুম্বাইয়ের মধ্যে ভারতের দীর্ঘতম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছেন আদানি।

ছয়টি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ আদানি এখন ভারতের বেসরকারি খাতে বৃহত্তম জ্বালানি প্রতিষ্ঠানের মালিক। এই সময়ে তিনি দেশে গ্রিন হাইড্রোজেনে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ ও আট হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় তিনি কয়লাখনি কিনেছেন। তাঁর লক্ষ্য, ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বের শীর্ষ নবায়নযোগ্য ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া।

আরও পড়ুন

ব্রিটিশ লেখক ও নীতি বিশ্লেষক জেমস ক্র্যাবট্রি তাঁর ‘দ্য বিলিয়নিয়ার রাজ: জার্নি থ্রু ইন্ডিয়াস নিউ গিল্ডেড এজ’ বইয়ে লিখেছেন, গৌতম আদানির ব্যবসায়িক বিস্তৃতি পূর্ববতী শিল্পপতিদের সঙ্গে অনায়াসে তুলনাযোগ্য।

জেমস ক্র্যাবট্রি লিখেছেন, ভারতের বিশৃঙ্খল অবকাঠামোর ওপর নির্ভর করতে না পেরে তিনি ব্যক্তিগতভাবে রেলপথ ও বিদ্যুৎ লাইন তৈরি করেছিলেন। দেশীয় কয়লার সহজলভ্যতার অভাবের কারণে তিনি ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার খনি কিনেছিলেন। সেখান থেকে পণ্য নিজের তৈরি বন্দর দিয়ে দেশে নিয়ে এসেছেন।

তবে ধনকুবের হলেও গৌতম আদানি অনেক বিতর্কেরও মুখোমুখি হয়েছেন। সেই গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এ কারণে বিতর্কের মুখে পড়েছেন তিনি। এ ছাড়া তাঁর ব্যবসাকে পুঁজিবাদের উদাহরণ হিসেবেও দেখা হয়।

গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে বিতর্কের মুখে পড়েন আদানি।
ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া

জেমস ক্র্যাবট্রি বলেছেন, ‘তাঁরা দুজন যৌথভাবে দারুণ ব্যবসায়িক ক্যারিয়ার উপভোগ করেছেন। মোদিন ব্যবসাপন্থী নীতি আদানির ব্যবসা সম্প্রসারণে অনেক সাহায্য করেছে। বিদেশি পুঁজি ও রপ্তানি শিল্পকে আকৃষ্ট করতে মোদির “গুজরাট মডেলের” প্রতীক হিসেবে আদানি অবকাঠামো বিনিয়োগের ওপর জোর দিয়ে বড় বড় প্রকল্প চালু করেছিলেন।’

অস্ট্রেলিয়া কুইনসল্যান্ডের গ্যালিলি বেসিনে একটি কয়লাখনির মালিক আদানি। এই কয়লাখনি বছরের পর বছর ধরে কয়লা ব্যবসায়ীপন্থী ও বিরোধীপন্থীদের বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল। এই বিতর্কের জেরে ২০১৯ সালে চূড়ান্ত নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত তা পরিবেশগত ছাড়পত্র পেতে আটকে ছিল। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক অলাভজনক ওয়েবসাইট আদানিওয়াচে বিশ্বজুড়ে আদানি গোষ্ঠীর নানা অপকর্মের তথ্য প্রকাশ করা হয়। তবে আদানি গ্রুপ অস্ট্রেলিয়ার কোনো আইন লঙ্ঘন করার কথা অস্বীকার করেছে।

আদানি ও অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে রাষ্ট্রচালিত গ্যাস কোম্পানি থেকে সস্তায় জ্বালানি সরবরাহ করার জন্য ২০১২ সালে গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অভিযুক্ত করে দেশটির সরকারি নিরীক্ষক।

আদানি ও অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে রাষ্ট্রচালিত গ্যাস কোম্পানি থেকে সস্তায় জ্বালানি সরবরাহ করার জন্য ২০১২ সালে গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অভিযুক্ত করে দেশটির সরকারি নিরীক্ষক। এ নিয়ে ২০১৭ সালে একজন সাংবাদিক ধারাবাহিক প্রতিবেদন করেছিলেন। ভাস্কর নামের ওই সাংবাদিক লিখেছিলেন, আদানির প্রতিষ্ঠানকে মোদি নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। তবে আদানি গ্রুপ ও মোদি সরকার এ ধরনের অভিযোগ নিয়মিত অস্বীকার করেছে।

এক সময় স্কুল থেকে ঝরে পড়া আদানি এখন ভারতের শীর্ষ ধনকুবের ও এশিয়ার শীর্ষ ধনীদের একজন।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

সাংবাদিক ভাস্কর বলেন, ‘তাঁর (আদানি) সম্পর্ক তৈরি ও বজায় রাখার ক্ষমতা অনেক। এটাই মূলত তাঁর ব্যবসা সম্প্রসারণে সহায়তা করেছে। তাঁর অধিকাংশ বন্ধুই “রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতা”। কেরালায় আদানির বন্দর প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়েছিল কমিউনিস্ট ও তৎকালীন প্রধান বিরোধী কংগ্রেস দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়। তাঁরাই এখন রাজ্য পরিচালনা করছেন এবং আদানির প্রকল্পকে সমর্থন করছেন। তিনি বলেন, আদানি বিশ্বাস করেন, যখন একটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর স্বার্থ “জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বিত” হয়, তখন প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হয়।’