আতিক আহমেদ: রাজনীতি–অপরাধ মিলিয়ে উত্থান, নিমিষেই পতন
ভিড়ের মধ্যে সাংবাদিকের ছদ্মবেশে থাকা বন্দুকধারীরা খুব কাছ থেকে দুই ভাইকে গুলি করে। ২২ সেকেন্ডে মোট ২০টি গুলি চালায় তিন খুনি। আতিকের শরীরে লাগে ৯টি, ৫টি গুলি লাগে আশরাফের শরীরে। নিহত হন দুজনই।
ভারতের উত্তর প্রদেশে অপরাধজগৎ থেকে রাজনীতিতে বড় উত্থানের সঙ্গে লোকসভার সাবেক সদস্য আতিক আহমেদের গল্প জড়িয়ে আছে। রাজনীতিতে আগমনের অন্তত এক দশক আগেই অপরাধীর তালিকায় নাম ওঠে তাঁর। ১৯৭৯ সালের ১০ নভেম্বর প্রয়াগরাজের খুলদাবাদ থানায় তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়। সেই থেকে শুরু। এরপর তিনি নিহত হওয়ার ঠিক এক দিন আগেও তাঁর বিরুদ্ধে ১০৪তম এফআইআর দায়ের করা হয়।
‘গ্যাংস্টার’ থেকে রাজনীতিবিদের তালিকায় নাম লেখানো আতিক আহমেদ ও তাঁর ভাই আশরাফ আহমেদ কারাগারে ছিলেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য গত শনিবার রাতে তাঁদের হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল। প্রয়াগরাজে হাসপাতালের সামনে পৌঁছার পর হাতকড়া পরা অবস্থায় তাঁরা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন। ভিড়ের মধ্যে সাংবাদিকের ছদ্মবেশে থাকা বন্দুকধারীরা খুব কাছ থেকে দুই ভাইকে গুলি করে। ২২ সেকেন্ডে মোট ২০টি গুলি চালায় তিন খুনি। আতিকের শরীরে লাগে ৯টি, ৫টি গুলি লাগে আশরাফের শরীরে। নিহত হন দুজনই।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়, প্রয়াগরাজের একটি ছোট্ট শহর চকিয়া থেকে আতিকের যাত্রা শুরু, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই শহরের ঐতিহাসিক সিভিল লাইনের একটি বড় অংশ তিনি দখলে নেন। ধীরে ধীরে তিনি প্রয়াগরাজ, এমনকি লক্ষ্ণৌর পার্শ্ববর্তী এলাকায়ও নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করেন। আতিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০১৫ সালে তিনি শহরের একজন সুপরিচিত ব্যবসায়ীর একটি জমি দখলে চেষ্টা করেছিলেন। লক্ষ্ণৌ পুলিশের ভাষ্য, আতিকের লোকেরা যখন জমি দখলের চেষ্টা করেছিলেন, তখন আতিক নিজেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
এ ঘটনার পর ওই ব্যবসায়ী থানায় অভিযোগ করেন। এরপর পুলিশ হস্তক্ষেপ করে। এরপর আতিক ওই ব্যবসায়ীর হোটেলে ঢুকে সব সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ করে দিয়ে তাঁকে হুমকি দেন। বলেন, ‘আমার ছবি তুলে যাকে খুশি পাঠাও। তোমার জমির দখল ফিরে পাবে না।’
২০১৮ সালে আতিক লক্ষ্ণৌর ব্যবসায়ী মোহিত জসেইয়ালের সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করেন। তাঁর লোকজন মোহিতকে অপহরণ করে দেওরিয়া কারাগারে বন্দী আতিকের সামনে হাজির করেন। সেখানে মোহিতকে লাঞ্ছিত করা হয় এবং সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে তাঁর ৪০ কোটি রুপির সম্পত্তির কাগজপত্রে সই করতে বাধ্য করা হয়। তবে উত্তর প্রদেশে বিজেপি ক্ষমতায় আসায় এরই মধ্যে অনেক কিছু বদলে যায়। ব্যবসায়ী মোহিতের মামলায় আতিকের ভাই আশরাফকে গ্রেপ্তার করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৯ সালে আতিককে দেওরিয়া কারাগারে থেকে সবরমতি কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ১৯৮৯ সালে পশ্চিম এলাহাবাদ আসন থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে আতিকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের উত্থান শুরু। এরপর দুইবার টানা বিধানসভা নির্বাচনে নিজের আসন নিশ্চিত করার পর সমাজবাদী পার্টি (এসপি) আতিকের জন্য দ্বার খুলে দেয়। ১৯৯৬ সালে সমাজবাদী পার্টির সদস্য হিসেবে পশ্চিম এলাহাবাদ আসন থেকে চতুর্থবারের মতো জয়ী হন তিনি।
উত্তরপ্রদেশের সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বিক্রম সিংয়ের ভাষ্যমতে, অভাবী মানুষের জন্য আতিকের দরজা ছিল সবসময় খোলা। তাদের জন্য হাত খুলে খরচ করতেন
লক্ষ্ণৌতে ‘গেস্ট হাউসে’ হামলার ঘটনায় ১৯৯৫ সালে হজরতগঞ্জ পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। হামলার সময় সেই গেস্ট হাউসে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী তাঁর দলের বিধায়কদের নিয়ে বৈঠক করছিলেন।
এরপর আতিকের জন্য ১৯৯৮ সালে সমাজবাদী পার্টির দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তখন তিনি স্থানীয় আপনা দলে যোগ দেন। ২০০২ সালে তিনি ওই দলের টিকিটে পশ্চিম এলাহাবাদ থেকে বিধানসভা নির্বাচনে জয় পান। ২০০৩ সালে আতিক আবার সমাজবাদী দলে ফিরে যান এবং পরের বছর ফুলপুর আসন থেকে লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হন। ২০১২ সালে বিধানসভা নির্বাচনে আপনা দল থেকে নিজের ভাগ্য যাচাই করতে যান আতিক। তবে এবার তিনি বহুজন সমাজ পার্টির পূজা পালের কাছে হেরে যান। কথিত আছে, কারাগারে থাকার সময় নির্বাচনে প্রচার চালানোর অনুমতি চেয়ে তিনি যখন হাইকোর্টে যান, তখন কয়েকজন বিচারপতি নিজেদের বিচারপ্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে নেন।
২০১৪ সালে তিনি শ্রাবস্তি আসন থেকে সমাজবাদী পার্টির টিকিটে লোকসভা নির্বাচনে অংশ নিয়ে হেরে যান। এভাবে হেরে গেলেও আতিকের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা কমেনি। তিনি কারাগার থেকে ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিপরীতে বারানসিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৮৫৫ ভোট পান।
হত্যার শিকার হওয়ার আগে পুলিশের নথিতে আতিক ভারতের আন্তরাজ্য গ্যাংয়ের তালিকায় ছিলেন ২২৭ নম্বরে। আতিকের ভাই আশরাফের নামে রয়েছে ৫৩টি মামলা। এর মধ্যে একটিতে তিনি বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন, অন্যগুলোর বিচার চলছিল।
আতিকের পাঁচ ছেলের মধ্যে দুজন বিভিন্ন মামলায় কারগারে আছেন। তৃতীয় ছেলে গত বৃহস্পতিবার উত্তর প্রদেশে পুলিশের এনকাউন্টারে নিহত হন। খুনের মামলায় সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগে ছোট দুই ছেলে (বয়স ১৮ বছরের কম) পুলিশ হেফাজতে আছে। আর আতিকের স্ত্রীর নামে রয়েছে চারটি মামলা। তিনি পলাতক।
বিবিসির খবরে বলা হয়, আতিক আহমেদের জন্ম এলাহাবাদের (বর্তমান প্রয়াগরাজ) একটি দরিদ্র পরিবারে ১৯৬২ সালে। অভাবের কারণে পড়াশোনায় স্কুল পার হতে পারেননি ।তবে অপরাধ জগতে যুক্ততা আর রাজনীতি মিলিয়ে বহু সম্পদের মালিক হয়েছেন। প্রভাব–প্রতিপত্তি বিস্তৃত করেছিলেন নিজ শহরের বাইরেও।
উত্তরপ্রদেশের সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বিক্রম সিংয়ের ভাষ্যমতে, অভাবী মানুষের জন্য আতিকের দরজা ছিল সবসময় খোলা। তাদের জন্য হাত খুলে খরচ করতেন। যে কেউ মেয়ের বিয়ের খরচ, ঈদের বকশিশ কিংবা সন্তানদের পড়াশোনার খরচের জন্য তাঁর কাছে গেলে খালি হাতে ফিরতে হতো না। বিক্রম সিংয়ের বর্ণনায় এই আতিক আহমেদ অনেকটা ‘রবিন হুড’ চরিত্রের মতো।