বিজেপি কেন পশ্চিমবঙ্গ ভেঙে নতুন রাজ্যের দাবি তুলছে

বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকাফাইল ছবি: রয়টার্স

লোকসভা ও বিধানসভার উপনির্বাচনের পর পশ্চিমবঙ্গ ভেঙে নতুন একাধিক রাজ্যের দাবি তুলেছেন বিজেপির কয়েকজন নেতা। যদিও এ দাবি রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে হঠাৎ করেই নতুন রাজ্যের দাবি রাজ্য রাজনীতিতে নতুন আলোচনা যোগ করেছে। এর নেপথ্যের কারণ হিসেবে কয়েকটি কারণের কথা বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

এর মধ্যে আছে এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবি, ছয় বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে গোহারা হওয়া। ক্রমাগত ব্যর্থতার পর রাজ্য বিজেপি রাজ্যের রাজনীতিকে সক্রিয় রাখার জন্যই নতুন করে ধুয়ো তুলেছে নতুন রাজ্যের। নতুন দাবির মধ্যে আছে সংখ্যালঘু মুসলিম অধ্যুষিত জেলা নিয়ে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ার। এর মধ্যে দিয়ে তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পোক্ত করতে চায়, রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এমনটাই ভাবছেন।

ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির আশা পূর্ণ হয়নি। এবার চার শ আসন পার হবে বলে প্রধানমন্ত্রী আশা করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল ফল হলো উল্টো। চার শ আসন দূরে থাক, এই প্রথমবারের মতো মোদিকে জোট সরকার গড়তে হলো বাধ্য হয়ে। আর পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির আসন কমে হয় ১২টি। এর আগের নির্বাচনে ২০১৯ সালে এই রাজ্যে ভারতের কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি পেয়েছিল ১৮ আসন। অপর দিকে, পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস তাদের আসন ১৮টি থেকে বাড়িয়ে নেয় ২৯টিতে। কংগ্রেস গতবার দুটি আসন পেলেও এবার পেয়েছে একটি।

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস প্রায় ৪৬ শতাংশ ভোট পায়। আর বিজেপি পায় প্রায় ৩৯ শতাংশ ভোট।

গত লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট মাত্র ২ শতাংশ। তবে বিজেপির ভোট কমেছে ২ শতাংশের কম।  

গত লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রধান ইস্যু করেছিল তৃণমূলের দুর্নীতিকে। কিন্তু তাদের সেই প্রচেষ্টা কাজে লাগেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এখন বিজেপির হাতে আর নতুন কোনো ইস্যু নেই এ রাজ্যে। তাই নতুন রাজ্যের দাবি তুলে তারা পরিস্থিতি গরম করতে চায়।

বিজেপির রাজ্য সভাপতি ও কেন্দ্রীয় উত্তর–পূর্ব ভারত উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার দাবি তোলেন, পশ্চিমবঙ্গে উত্তরবঙ্গের অবহেলিত আট জেলাকে উন্নয়ন করার লক্ষ্যে উত্তর–পূর্ব ভারতের সঙ্গে যুক্ত করা হোক। যদিও সুকান্তের এই ডাকে সাড়া মেলেনি বিজেপির নেতৃত্বের কাছ থেকে। বরং বিজেপির নেতারা বিরোধিতা করেছেন।

এরপর পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের ছয় মুসলিম অধ্যুষিত জেলা নিয়ে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ার দাবি তোলেন ভারতের লোকসভার ঝাড়খন্ডের বিজেপি সংসদ সদস্য নিশিকান্ত দুবে। সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল। তারা জানিয়ে দেয়, বঙ্গভঙ্গ নয়, বাংলা থাকবে বাংলাতেই। বাংলা আর ভাগ নয়। বিজেপির এই ষড়যন্ত্র রুখবে বাংলার মানুষই।

শুধু তা–ই নয়, বিজেপির শরিক মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের দল জেডিইউ বা সংযুক্ত জনতা দলও একইভাবে প্রত্যাখ্যান করে দেয় বিজেপির সংসদ সদস্যের ওই দাবিকে। তাঁরাও দাবি করেন বিহার থাকবে বিহারেই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে। বিহার ভাগ হবে না।

গত শনিবার আবার সংসদ সদস্য নিশিকান্ত দুবের প্রস্তাব সমর্থন করেন বহরমপুরের বিজেপির বিধায়ক সুব্রত মৈত্র। নিশিকান্ত দুবের প্রস্তাবকে সমর্থন করে তাঁর দাবির সঙ্গে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ার প্রশ্নে নতুন করে উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর এবং নদীয়ার একটি অংশকে যুক্ত করার দাবি তোলেন তিনি। তাঁরও বক্তব্য, ওই তিনটি জেলায় অনুপ্রবেশের ভারে পাল্টে যাচ্ছে জনবিন্যাস। তাই এই পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি জেলাকে প্রস্তাবিত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করা হোক। সেই দাবিও প্রত্যাখ্যান করেছে তৃণমূলসহ কংগ্রেস ও বাম দল।

এ ছাড়া উত্তরবঙ্গের কোচবিহারের বিজেপির রাজ্যসভার সদস্য (এমপি) অনন্ত মহারাজও একই সময়ে একই সঙ্গে দাবি তোলেন কোচবিহারকে নিয়ে আলাদা বৃহৎ কোচবিহার রাজ্য গড়ার। এ দাবি তাঁর দীর্ঘদিনের। অনন্ত মহারাজ বিজেপির রাজ্যসভার সদস্য। তাঁর নিজের দলের নাম গ্রেটার কোচবিহার ডেমোক্রেটিক পার্টি।

এ ছাড়াও রয়েছে দার্জিলিংকে নিয়ে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার দাবি। ফলে পশ্চিমবঙ্গ ভেঙে নতুন নতুন এসব দাবি তোলায় অস্বস্তিতে পড়েছে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। যদিও তারা ঘোষণা দিয়েছে, আর বঙ্গভঙ্গ নয়। বাংলা থাকবে বাংলাতেই। বাংলার মানুষ বিজেপির এই বঙ্গভঙ্গের ষড়যন্ত্র রুখবে। একই দাবি কংগ্রেস ও বাম দলেরও।

বিজেপির সংসদ সদস্য নিশিকান্ত দুবে ঝাড়খন্ড রাজ্যের আদিবাসী এলাকা গোড্ডা কেন্দ্র থেকে সংসদ সদস্য হয়েছেন। বিজেপির সংসদ সদস্য নিশিকান্ত দুবে অভিযোগ করেছেন, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের ওই ছয় জেলায় ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটায় সেখানকার জনবিন্যাস বদলে যাচ্ছে। অনুপ্রবেশকারীরা বিহারে আদিবাসী নারীদের বিয়ে করে পাল্টে দিচ্ছে জনবিন্যাসের হার। সাঁওতাল পরগনা বিহার রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সময় এই রাজ্যের আদিবাসী জনসংখ্যা ছিল ৩৬ শতাংশ। এখন তা নেমে দাঁড়িয়েছে ২৬ শতাংশে।

অন্যদিকে মুর্শিদাবাদ ও মালদহে চলছে নিয়মিত অনুপ্রবেশ। তাই দুবে দাবি করেন, এই ছয় জেলাকে নিয়ে পৃথক একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়া হোক। একই সঙ্গে সেখানে কার্যকর করা হোক এনআরসি।

রাজ্য রাজনীতিকে তপ্ত করতে বিজেপির নতুন রাজ্যের দাবি আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে এ নিয়ে নিজেদের মধ্যেই মতবিরোধ ছিল। শুধু শাসক তৃণমূল নয়, অন্য বিরোধী দলগুলোও বিজেপির দাবিকে মেনে নেয়নি। তাই এ দাবি বড় কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন গড়তে পারবে বলে আপাতত মনে হচ্ছে না।