বিচ্ছিন্নতাবাদের তকমা দেওয়া কারাবন্দীদের জয় কী বার্তা দিচ্ছে
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের একটা ছবি নিয়ে আম আদমি পার্টি (আপ) এবার নির্বাচনী প্রচার মাতিয়ে দিয়েছিল। ছবিটা জেলের গরাদবন্দী কেজরিওয়ালের। দলের স্লোগান মুখ্যমন্ত্রীই ঠিক করে দিয়েছিলেন—‘জেলের জবাব ব্যালটে’। দিল্লির জনতা তা শোনেনি। রাজধানীতে আপ একটিও আসনে জেতেনি। দেশে সব মিলিয়ে মোটে তিনটি আসন জিতেছে তারা।
অথচ আপ–শাসিত রাজ্য পাঞ্জাবে কারাবন্দী একজন এবার লোকসভায় জিতে গেলেন। তিনি স্বঘোষিত স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র খালিস্তানের নেতা অমৃতপাল সিং। এ রাজ্য থেকে জিতেছেন আরও একজন, যাঁর বাবা ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর দুই ঘাতকের একজন—বিয়ন্ত সিং। বিয়ন্তের ছেলে সরবজিৎ সিং খালসা এবার অমৃতপালের মতোই জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, পাঞ্জাবে প্রথামাফিক রাজনীতির বাইরে এক অন্য হাওয়া বইছে।
শুধু এই দুজনই নন, কাশ্মীর উপত্যকার বারামুলা আসন থেকে জয়ী হয়েছেন যিনি, তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী কাজ ও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বন্দী রয়েছেন। সেই স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রকৌশলী রশিদ হারিয়েছেন জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহকে। এই তিনজনের জয় অনেক প্রশ্ন তুলে দিল। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁদের জয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর চিন্তা বাড়াবে।
অমৃতপাল জিতেছেন পাঞ্জাবের খাদুর সাহিব আসন থেকে। হারিয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী কুলবীর সিং জিরাকে প্রায় দুই লাখ ভোটের ব্যবধানে। সরবজিৎ সিং খালসা জিতেছেন ফরিদকোট থেকে। ৭০ হাজার ভোটে তিনি হারিয়েছেন আপ প্রার্থী করমজিৎ সিং আনমোলকে।
অমৃতপাল সিং প্রথম সর্বভারতীয় পরিচিতি পান কৃষক আন্দোলনের সময়। স্বাধীন খালিস্তানের প্রবক্তা সন্ত জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের আদর্শে নিজেকে গড়ে তোলা এই স্বঘোষিত খালিস্তানি নেতা দিল্লির লালকেল্লায় শিখ ধর্মের পতাকা তুলে দিয়েছিলেন পুলিশি পাহারাকে ফাঁকি দিয়ে। ‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে’ নামের এক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তার মাধ্যমেই চলত বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচার। তাঁকে ধরতে সক্রিয় হয় পাঞ্জাবের আম আদমি সরকার। সেই কাজে রাজ্য সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা করেছিলেন অমিত শাহ।
অমৃতপালের সংগঠনকে তছনছ করে দেওয়া হয়। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তাঁকে ধরতে গড়ে তোলা হয় পুলিশের বিশেষ দল। এক মাস চোর-পুলিশ খেলা শেষে শেষ পর্যন্ত গত বছরের ২৩ এপ্রিল গ্রেপ্তার করা হয় অমৃতপালকে। নিরাপত্তার কারণে দিল্লির তিহার জেল থেকে সরিয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় আসামে। এখনো সেখানকার ডিব্রুগড় জেলেই তিনি বন্দী। জেলে থেকেই তিনি মনোনয়নপত্র জমা দেন। শিরোমণি অকালি দলের (অমৃতসর) নেতা সিমনরজিৎ সিং মান সমর্থন জানান অমৃতপালকে। প্রায় বিনা প্রচারেই তিনি জয়ী হন।
একইভাবে জিতে যান সরবজিৎ সিং খালসাও। গত ১১ এপ্রিল হঠাৎই তিনি ভোটে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন ফরিদকোট থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীই সহযোগিতা পান ধর্মপ্রাণ শিখ সম্প্রদায়ের। কেন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ছেড়ে রাজ্যের বিপুলসংখ্যক মানুষ এ ধরনের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন এবং তাঁদের জেতাচ্ছেন, কেন্দ্রীয় সরকারকে তা ভেবে দেখতে হবে।
পাঞ্জাবে কারও কারও বিরুদ্ধে শিখধর্মের অবমাননার অভিযোগ রয়েছে সেই ২০১৫ সাল থেকে। বারবার বহু দল ও নেতা এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। কিন্তু সুবিচার এখনো হয়নি বলে অভিযোগ। সরবজিৎ সিং তাঁর সুবিচার চাওয়ার পাশাপাশি প্রচারে তুলে ধরেন মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও বন্দিদশা না ঘোচা শিখদের সমস্যা, মাদক সমস্যা, ফসলের সহায়ক মূল্যের আইনি স্বীকৃতি, নদীর পানি বণ্টন সমস্যার মতো বিষয়গুলো। ২০১৪ সালেও সরবজিৎ লোকসভা ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। সেবার অবশ্য জেতেননি।
অমৃতপালের জয় পাঞ্জাবে প্রচ্ছন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতাকে তুলে ধরেছে। এ রাজ্য থেকে হাজার হাজার শিখ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় গিয়ে খালিস্তানি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। কারাগারে থেকে অমৃতপালের ভোটে জয় সে ক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল।
শুধু পাঞ্জাবই নয়, কাশ্মীরকে বদলে দেওয়ার সগর্ব ঘোষণাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন বারামুল্লা থেকে জয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রকৌশলী রশিদ। ৫৬ বছরের এই রাজনীতিবিদ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে অর্থ লেনদেন করার অভিযোগে ২০১৯ সাল থেকে দিল্লির তিহার জেলে বন্দী রয়েছেন। এনআইয়ের হাতে এই বন্দীর হয়ে পুরো প্রচার চালিয়েছেন তাঁর দুই ছেলে আবরার রশিদ ও আসরার রশিদ। ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের বিরোধিতা তাঁর মূল দাবি। সেই সঙ্গে ছেলেরা প্রচার করে গেছেন, বাবাকে জেতালে উপত্যকার প্রতি অবিচারের জবাব দেওয়া যাবে। জয়ী হলে হয়তোবা তাঁদের বাবা মুক্তি পাবেন।
বিস্ময়ের কথা, প্রকৌশলী রশিদ হারিয়েছেন ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা ও রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাকে। পরাজয় মেনে ও রশিদকে অভিনন্দন জানিয়ে ওমর টুইট করে বলেছেন, ‘জয়ী হলেই যে রশিদ মুক্তি পাবেন, তা বিশ্বাস করি না। আবার এটাও ঠিক, তাঁর জয় সত্ত্বেও উত্তর কাশ্মীরের মানুষের দাবি সংসদে পৌঁছাবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলব, গণতন্ত্রে মানুষ যে তার মতামত জাহির করতে পেরেছেন, সেটা কম নয়।’
বিজেপি এই ভোটে কাশ্মীর উপত্যকায় কোনো প্রার্থী দেয়নি। যাঁদের তারা সমর্থন দিয়েছিল, তাঁরাও কেউ জিততে পারেননি। উপত্যকার অন্য দুটি আসন জিতেছে ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি)। লাদাখের একটি মাত্র আসন পেয়েছে এনসি ছেড়ে বেরিয়ে আসা স্বতন্ত্র প্রার্থী মহম্মদ হানিফা। তিনি হারিয়েছেন কংগ্রেস ও বিজেপির প্রার্থীদের।
৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর বিজেপি বারবার দাবি করে এসেছে, কাশ্মীরের সবকিছু স্বাভাবিক। কিন্তু জেলবন্দী প্রকৌশলী রশিদের জয় বুঝিয়ে দিল, মানুষের মনের ক্ষতে এখনো প্রলেপ পড়েনি। পাঞ্জাব ও কাশ্মীরের এই তিন প্রার্থীর জয় ভারত সরকারের জন্য চিন্তার।