গুজরাটে নির্বাচনী ভাষণে মুসলমানদের উদ্দেশে ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার প্রসঙ্গ তোলায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বিরুদ্ধে নালিশ জমা পড়েছে। ভারত সরকারের এক সাবেক আমলা ও অধিকার রক্ষা আন্দোলনকর্মী সংগঠনের পক্ষে ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন জানিয়ে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্বাচনী আচরণবিধি শুধু ভঙ্গই করেননি, সমাজে বিভাজন সৃষ্টিরও চেষ্টা করেছেন। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই তদন্ত করে তাঁকে শাস্তি দেওয়া হোক।
আবেদনকারীরা ‘পরিস্থিতি অনুকূল নয়’ দাবি করে গুজরাট নির্বাচন অনির্দিষ্টকাল স্থগিত রাখতে কমিশনকে অনুরোধ করেছেন।
নির্বাচন কমিশনে এই নালিশ জমা করেছেন ভারত সরকারের সাবেক সচিব ই এ এস শর্মা। একই বিষয়ে অন্য একটি আবেদন পাঠিয়েছেন আমেদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের সাবেক অধ্যাপক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকর্মী জগদীপ ছোকর। গুজরাটের খেরা জেলায় অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনী সমাবেশে শাহের ভাষণের রিপোর্ট (সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের) দাখিল করে নির্বাচন কমিশনকে শর্মা বলেছেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষণের ওই সব মন্তব্য ‘অত্যন্ত আপত্তিকর’। ওই ভাষণে তিনি ধর্মীয় ভেদাভেদ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। হিংসা ও শত্রুতায় উসকানি দিয়েছেন। একই বক্তব্য জগদীপ ছোকরের। তাঁর দাবি, এই মন্তব্যের দরুন ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন মোতাবেক অমিত শাহর সংসদ সদস্য পদ খারিজ হওয়া দরকার।
২৫ নভেম্বর গুজরাটে এক নির্বাচনী জনসভায় অমিত শাহ বলেছিলেন, কংগ্রেস আমলে রাজ্যে দাঙ্গা লেগেই থাকত। ভোট ব্যাংকের রাজনীতি করতে কংগ্রেস দাঙ্গাবাজদের অশান্তি সৃষ্টিতে উসকানি দিত। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালে ‘ওদের উচিত শিক্ষা’ দিয়েছে। সেই শিক্ষা এমনই যে পরের ২০ বছর ধরে রাজ্যে শান্তি বিরাজ করছে। দাঙ্গাবাজেরা হিংসার দিকে পা বাড়ায়নি।
অমিত শাহ তাঁর ভাষণে ‘ওদের’ বলতে কাদের বুঝিয়েছেন, তা স্পষ্ট করেননি। ‘উচিত শিক্ষাও’ যে কী এবং কীভাবে তা দেওয়া হয়েছে, সেই ব্যাখ্যায় যাননি। যদিও রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন মহলের অভিযোগ, অমিত শাহ ওদের বলতে মুসলমানদের ইঙ্গিত করেছেন। ২০০২ সালের সেই বিধ্বংসী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রাজ্যে সরকারি হিসাবে নিহত হয়েছিলেন ১ হাজার ৪৪ জন। আহত হয়েছিলেন ২ হাজার ৫০০ জন। নিখোঁজের সংখ্যা ছিল ২২৫। বেসরকারি মতে, নিহতের সংখ্যা ২ হাজারের বেশি। সরকারিভাবে নিহতদের মধ্যে মুসলমান ছিলেন ৭৯০ জন, হিন্দু ২৫৪ জন। আগুন ও লুটপাটের দরুন সম্পত্তি নষ্টের পরিমাণ কত, তার কোনো হিসাব নেই।
নির্বাচন কমিশন সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় নির্বাচন নিয়ামক সংস্থা অমিত শাহর ভাষণের রেকর্ডিং ও রাজ্যের প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তার রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে। গুজরাট বিধানসভার দুই দফার ভোটের প্রথম পর্ব শুরু ১ ডিসেম্বর। দ্বিতীয় দফার ভোট ৫ ডিসেম্বর। গণনা ও ফল ঘোষণা ৮ ডিসেম্বর।
প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, নির্বাচন কমিশন আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেবে কি না। কিংবা অমিত শাহর ভাষণ কমিশন আপত্তিকর মনে করবে কি না।
সংশয়ের কারণ, ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছিল। মোদির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তিনি মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকে পুলওয়ামা প্রসঙ্গের অবতারণা করে ভোট চেয়েছিলেন। পুলওয়ামার শহীদদের স্মরণ করে জনগণকে ভোট দিতে বলেছিলেন। কেরালার ওয়েনাড থেকে রাহুল গান্ধীর প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রসঙ্গ তুলে মোদি বলেছিলেন, মুসলমানদের তোষামোদ করতেই রাহুল ওয়েনাড বেছে নিয়েছেন।
অমিত শাহর বিরুদ্ধেও সে সময় একটি অভিযোগ জমা পড়েছিল। শাহ বলেছিলেন, রাহুল যেখান থেকে দাঁড়িয়েছেন, সেখানে শোভাযাত্রা বের হলে বোঝা দুষ্কর জায়গাটা ভারত না পাকিস্তান। সেই সময় তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন পাঁচ অভিযোগ থেকেই মোদি-শাহকে মুক্তি দিয়েছিল। তবে তা সর্বসম্মতিতে হয়নি। অন্যতম নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসা মোদি-শাহর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ যথার্থ মনে করে ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন।
নির্বাচন কমিশনের গঠন ও তার কাজকর্মে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বীতশ্রদ্ধ। কমিশনের আচরণ ও সদস্যদের নিয়োগ পদ্ধতিসংক্রান্ত এক মামলার শুনানিতে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট কঠোর মন্তব্য করেছেন। সরকারের তাঁবেদার বা জি হুজুরদের কমিশনের সদস্য মনোনীত করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। কমিশনের নিরপেক্ষতা ও ঋজুতা-দৃঢ়তা নিয়ে তীব্র সংশয় প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলেন, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ছিলেন একজনই। টি এন শেসন। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা রক্ষায় সদস্য নিযুক্তিতে দেশের প্রধান বিচারপতিকে অংশীদার করার ওপর সুপ্রিম কোর্ট জোর দিয়েছেন। ফলে গুজরাটে শাহ-মন্তব্যের মধ্যে কমিশন আদৌ আপত্তিজনক কিছু খুঁজে পাবে কি না, আগ্রহ দানা বেঁধেছে তা নিয়ে।