হট্টগোলেই শেষ ভারতের পার্লামেন্ট অধিবেশন, রাহুলের বিরুদ্ধে এফআইআর

ভারতের কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীফাইল ছবি

হট্টগোলেই শেষ হলো ভারতীয় পার্লামেন্টের শীতকালীন অধিবেশন। তবে তার আগে কেন্দ্রীয় সরকার ‘এক দেশ এক ভোট’ বিলটি আরও বিবেচনার জন্য ৩৯ সদস্যবিশিষ্ট যুগ্ম সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠিয়েছে। এদিকে পার্লামেন্টে গতকাল হট্টগোলের সময় সরকারপক্ষের দুই সংসদ সদস্যকে ধাক্কা দেওয়ার অভিযোগে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে পুলিশ এফআইআর দায়ের করেছে।

এবারের অধিবেশনের সিংহভাগ অচল ছিল নানা কারণে। কিন্তু ভারতের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা আম্বেদকরের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর অসম্মানজনক মন্তব্যের প্রতিবাদে দুই দিন ধরে যা হলো, তা এককথায় অভূতপূর্ব। আম্বেদকরের ছবি নিয়ে সংসদ ভবন চত্বরে সরকার ও বিরোধী পক্ষের সদস্যরা যে ধরনের ক্ষোভ ও বিক্ষোভ দেখান; যেভাবে দুই পক্ষ একে অন্যের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের অভিযোগ এনেছে, অতীতে তা কখনো দেখা যায়নি। শুধু তা–ই নয়, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে সরকারপক্ষের দুই সাংসদকে ধাক্কা দিয়ে আহত করার অভিযোগও পুলিশের কাছে দাখিল করা হয়। একই ধরনের অভিযোগ কংগ্রেসও এনে বলেছে, সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেকে বিজেপি সদস্যরা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন। বিজেপির অভিযোগকে আমলে নিয়ে দিল্লি পুলিশ রাহুলের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে। এমন ঘটনাও সংসদীয় ভারতের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত ঘটেনি।

সরকার ও বিরোধী পক্ষের সম্পর্ক কোন তলানিতে ঠেকেছে, তার প্রমাণ রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাব আনা। পদ্ধতিগত কারণ দেখিয়ে যদিও সেই প্রস্তাব খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। আজ শুক্রবার লোকসভার অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি করার পর লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার ডাকা প্রথামাফিক চায়ের আসর ‘ইন্ডিয়া’ জোট নেতারা বর্জন করেন। বিরোধী নেতারা জানান, যেখানে সদস্যদের বিরুদ্ধে এফআইআর দাখিল করা হয়, সেখানে এই সৌজন্য অর্থহীন।

রাহুলের বিরুদ্ধে দায়ের করা এফআইআরের মোকাবিলা কংগ্রেস রাজনৈতিকভাবে করতে চাইছে। দলের নেতা কে সি বেনুগোপাল বলেছেন, আম্বেদকরের অসম্মানের প্রতিবাদের জন্য বিজেপির এই চাল রাহুলের কাছে সম্মানের তকমা। আর প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বলেছেন, ‘রাহুল আমার বড় ভাই। ধাক্কাধাক্কি করা তাঁর চরিত্রবিরোধী। যে অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, কেউ তা বিশ্বাস করে না। আমি তাঁর বোন হয়ে তা জানি। সারা দেশও জানে।’

গত বৃহস্পতিবারই রাহুল ও খাড়গে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, আম্বেদকর ইস্যুতে কোণঠাসা বিজেপি ধাক্কাধাক্কির অভিযোগ এনে দেশবাসীর নজর ঘোরাতে চাইছে। শুক্রবারও তাঁরা এ কথা বলেন। আদানি বা অন্য ইস্যুতে বিরোধীরা জোটবদ্ধতার পরিচয় রাখতে না পারলেও আম্বেদকর ইস্যু বিরোধীদের এককাট্টা করেছে। শুক্রবার তাই দেখা যায় প্রিয়াঙ্কা ও অখিলেশ যাদবকে একযোগে সরব হতে।

প্রিয়াঙ্কা বলেন, আম্বেদকর ও দলিতদের বিজেপি কোন চোখে দেখে, তা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় শাসক দল ভয় পেয়েছে। সেখান থেকে পরিত্রাণের জন্য তারা রাহুলের বিরুদ্ধে অবাস্তব ও মনগড়া অভিযোগ এনেছে।

অমিত শাহর পদত্যাগ ও ক্ষমা প্রার্থনা দাবি করে সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উচিত প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া। আম্বেদকরের তৈরি সংবিধান দেশের ধ্রুবতারা, অথচ বিজেপি তা ছারখার করে দিতে বদ্ধপরিকর।

রাহুল গান্ধী ধাক্কা দিয়ে বিজেপির দুই সাংসদকে ফেলে দিচ্ছেন এবং তাতে তাঁরা আহত হচ্ছেন, এমন কোনো ভিডিও ক্লিপিং কেউ দেখাতে পারেননি। যদিও ‘আহত’ দুই সংসদ সদস্য প্রতাপ সারঙ্গি ও মুকেশ রাজপুতকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুজনের অবস্থাই স্থিতিশীল জানানো হয়েছে।

প্রতাপ সারঙ্গি প্রচারের আলোয় এসেছিলেন ১৯৯৯ সালে। ওই বছর ওডিশায় অস্ট্রেলীয় খ্রিষ্টধর্ম প্রচারক গ্রাহাম স্টেইনস এবং তাঁর দুই পুত্র ফিলিপ ও টিমোথিকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। অভিযোগ, সেই ঘটনায় হিন্দুত্ববাদী দুই ব্যক্তি দারা সিং ও প্রতাপ সারঙ্গি জড়িত ছিলেন। দারা সিংকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, সারঙ্গিসহ অন্য ১১ জনের যাজ্জীবন। পরবর্তীকালে দারা সিংয়ের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয় এবং প্রমাণের অভাবে সারঙ্গিদের মুক্তি দেওয়া হয়। সেই সারঙ্গি ২০১৯ সালে জিতে মোদি মন্ত্রিসভার মন্ত্রী হয়েছিলেন।

অধিবেশন মুলতবি করার আগে স্পিকার ওম বিড়লা জানান, এর পর থেকে আর কোনো সদস্যকে সংসদ ভবনের প্রবেশমুখে কোনো রকম বিক্ষোভ করতে দেওয়া হবে না। গত বৃহস্পতিবার বিরোধীরা যখন সংসদ ভবন চত্বরে আম্বেদকরের স্ট্যাচুর সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন, বিজেপি তখন প্রবেশদ্বার আটকে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। অধিবেশনকক্ষে ঢোকার জন্য বিরোধীরা প্রবেশদ্বারের কাছে এলে বিজেপি সদস্যরা বাধা দেন। অভিযোগ, সে সময় সরকারপক্ষের ওই দুই সদস্য আহত হন।

রাহুলের বিরুদ্ধে ধাক্কা দেওয়ার অভিযোগে শুধু এফআইআরই নয়, আম্বেদকর ইস্যুর মোকাবিলা বিজেপি অন্যভাবেও করতে চাইছে। যেমন দলের এক নারী সংসদ সদস্যকে অসম্মান করার অভিযোগ আনা হয়েছে রাহুলের বিরুদ্ধে। সেই নারী, নাগাল্যান্ডের বিজেপি নেত্রী ফাঙ্গনন কন্যাক রাজ্যসভার চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে বলেছেন, ধাক্কাধাক্কির সময় রাহুল তাঁর এত কাছে চলে এসেছিলেন যে তিনি অস্বস্তি বোধ করছিলেন। অমিত শাহর বিবৃতি ‘বিকৃতভাবে’ উপস্থাপনের অভিযোগ আনতে চাইছে বিজেপি। কংগ্রেসের যাঁরা শাহর ভাষণের ক্লিপিং প্রচার করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজেপি। কংগ্রেস আবার শাহর বিরুদ্ধে অধিকারভঙ্গের নোটিশ দিয়েছে। দুই শিবিরের এমন যুযুধান অবস্থান অতীতে দেখা যায়নি।