পাঞ্জাবের পর এবার রাজস্থানেও সংকটে পড়তে যাচ্ছে কংগ্রেস
তিন–চার দিন আগেও মনে করা হচ্ছিল, কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মরুরাজ্য রাজস্থানে ক্ষমতার হাতবদল মসৃণ হবে। আচমকা পটপরিবর্তনের ফলে এখন মনে হচ্ছে, নাটকীয়তার অনেক কিছুই এখনো পর্দার আড়ালে। অনেক চমক এখনো বাকি। শাহরুখ খানের জনপ্রিয় সিনেমার সংলাপ ধার করে বলা যায়, ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত।’
কারণ, বেঁকে বসেছেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট। কংগ্রেস হাইকমান্ডের ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে নিজের অনুগতদের দিয়ে বলিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে শচীন পাইলটকে তাঁরা কিছুতেই মানবেন না। এ বিষয়ে জবরদস্তি করা হলে তাঁরা পদত্যাগ করবেন। গেহলটের ইশারায় তাঁর অনুগামীরা এআইসিসির পাঠানো দুই প্রতিনিধি মল্লিকার্জুন খাড়গে ও অজয় মাকেনের ডাকা বোরবারের পরিষদীয় দলের বৈঠকই শুধু বর্জন করেননি, বিধানসভার স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার কথাও শুনিয়ে রেখেছেন।
রাজস্থানের বিধায়কেরা কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকদের কাছে একটি প্রস্তাব জমা দেন। তাতে বলা হয়, নতুন মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন, তা নির্ণয়ের ভার নতুন নির্বাচিত কংগ্রেস সভাপতিকে যেন দেওয়া হয়। এই প্রস্তাব নাকচ করে অজয় মাকেন বলেন, সেটা করতে দেওয়া হলে তা হবে স্বার্থের সংঘাত। অশোক গেহলট কংগ্রেসের সভাপতি হলে নিজেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করতে পারেন। বিধায়কদের মন বুঝতে খাড়গে ও মাকেনকে বলা হয়েছিল প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলতে। বিষয়টি বিধায়কদেরও জানানো হয়েছিল। কিন্তু কেউ আলাদাভাবে কথা বলতে আসেননি। এ কারণে অপমানিত ও অসম্মানিত খাড়গে ও মাকেন আজ সোমবার বিকেলে দিল্লিতে ফিরে আসেন। সন্ধ্যায় তাঁরা ১০ জনপথে যান সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে কথা বলতে।
কংগ্রেসের কাছে রাজস্থান এই মুহূর্তে শাঁখের করাত। শ্যাম না কুল—গান্ধী পরিবার কোনটা রাখবে। গেহলট না শচীন—কার ইচ্ছা ও দাবিকে মর্যাদা দেবে, সেই দোলাচলে বিহ্বল। গত বছর কংগ্রেসশাসিত পাঞ্জাবে যে চিত্রনাট্য লেখা হয়েছিল, আজকের রাজস্থান ঠিক যেন তারই প্রতিচ্ছবি!
সিদ্ধান্ত যা কিছু নেওয়ার সব পক্ষকেই দ্রুত নিতে হবে। কারণ, কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ৩০ সেপ্টেম্বর। অবশ্য এখন পর্যন্ত কেউ মনোনয়নপত্র জমা দেননি। গেহলট নিজেই জানিয়েছিলেন আজ মনোনয়নপত্র দাখিল করবেন। কিন্তু রাজ্য রাজনীতির জট তাঁকে রাজ্যে বন্দী রেখেছে। শোনা যাচ্ছে, আগামীকার মঙ্গলবার তিনি দিল্লিতে আসতে পারেন। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি রাজ্য ছেড়ে দলের দায়িত্ব নিতে চাইবেন কি না, সেই প্রশ্নও এখন মাথাচাড়া দিচ্ছে।
দিল্লির আকবর রোডে কংগ্রেস সদর দপ্তরে ঘুরপাক খাচ্ছে নানা জল্পনা। শচীন পাইলটকে মুখ্যমন্ত্রী মানতে নারাজ গেহলট গান্ধী পরিবারের পাঠানো এআইসিসি প্রতিনিধিদের অসম্মান করেছেন। যেভাবে সরকার ফেলে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে, তাতে সোনিয়া–রাহুল–প্রিয়াঙ্কা বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। এআইসিসির এক পদাধিকারী আজ প্রথম আলোকে বলেন, গান্ধীরা বিস্মিত। কারণ, অশোক গেহলটকে তাঁরা একান্ত অনুগত বলে এত দিন ভেবে এসেছেন। ভেবেছেন বলেই সভাপতি হিসেবে গেহলট তাঁদের প্রথম পছন্দ ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে অমোঘ প্রশ্ন, এত কিছুর পর সভাপতি হিসেবে গেহলট এখনো গান্ধী পরিবারের পছন্দের প্রার্থী থাকবেন কি না।
এই সংশয়ের কারণও এআইসিসির ওই পদাধিকারী ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর কথায়, ‘মল্লিকার্জুন খাড়গে ও অজয় মাকেনকে গেহলট বলেছেন, বিধায়কদের ওপর তাঁর নাকি কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নিজের রাজ্যের অনুগামী বিধায়কদের ওপর যাঁর নিয়ন্ত্রণ নেই, তিনি কী করে দলের সভাপতি হয়ে এতগুলো রাজ্য সামাল দেবেন?’ ওই পদাধিকারী বলেন, গেহলট নিজেই এই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। তা ছাড়া দলের স্বার্থের চেয়ে নিজের রাজ্যকে তিনি বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। এই সিদ্ধান্তহীনতার কারণে কংগ্রেস সদর দপ্তরে জোর জল্পনা চলছে, দিগ্বিজয় সিং, কমলনাথ বা মল্লিকার্জুন খাড়গের মতো কেউ শেষ মুহূর্তে সভাপতি পদে প্রার্থী হিসেবে গান্ধী পরিবারের পছন্দের হয়ে উঠবেন কি না। আজ সন্ধ্যায় কমলনাথ দেখা করেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে, তাতে জল্পনা আরও বেড়েছে। কোনো কোনো মহল মনে করছে, গেহলটকে বাগে আনতে কমলনাথকে দূত করা হতে পারে।
জট ভালোমতো পাকিয়ে ওঠায় পরিত্রাণের উপায় নিয়ে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। এতখানি এগিয়ে গেহলট শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে আসবেন কি? মুখ বুজে মেনে নেবেন দলের সিদ্ধান্ত? এটা মোক্ষম প্রশ্ন। তেমনই বড় প্রশ্ন, দেড় বছরের বেশি সময় অপেক্ষারত শচীন পাইলট শেষ পর্যন্ত অনুগত ও বাধ্য থাকবেন কি না। দেড় বছর আগে গান্ধীদের কথায় বিদ্রোহ ছেড়ে তিনি অপেক্ষায় থাকতে শুরু করেন। গেহলটের স্থলাভিষিক্ত হতে না পেরে তিনি যদি দলত্যাগ করেন, তাহলে কংগ্রেস তাঁকে অপরাধী ঠাওড়াতে পারবে না। শচীন একদা উপমুখ্যমন্ত্রী ও দলের রাজ্য সভাপতি ছিলেন। বিদ্রোহের পর থেকে তিনি শুধুই বিধায়ক। মুখ্যমন্ত্রিত্ব না পেয়ে তিনি কি রাজ্য সভাপতি হয়ে সন্তুষ্ট থাকবেন? আগামী শুক্রবারের মধ্যে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের এই জট ছাড়াতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, এই সংকট কংগ্রেসেরই তৈরি। এটাও বোঝা যাচ্ছে, রাজস্থান নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে কংগ্রেস হাইকমান্ডের হোমওয়ার্ক কতটা ত্রুটিপূর্ণ ছিল। সমস্যা যে জটিল হয়ে উঠতে পারে, সে ধারণাই কারও ছিল না। সোনিয়া–রাহুল ভেবেছিলেন, অশোক গেহলটকে কংগ্রেস সভাপতি করে দিলেই সব কিছুর সমাধান হয়ে যাবে। গেহলট গুরুদায়িত্ব পেয়ে সন্তুষ্ট থাকবেন। তাঁরাও শহীন পাইলটকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করতে পারবেন।