ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর নির্বাচনী বন্ড নিয়ে সব তথ্য প্রকাশ করেছে দেশটির নির্বাচন কমিশন ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই)। আগেই জানা গিয়েছিল, কোন প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি বন্ড কিনেছে এবং এই বন্ডের মাধ্যমে কোন দল সবচেয়ে বেশি অনুদান পেয়েছে। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ তথ্যে কোন প্রতিষ্ঠান, কোন রাজনৈতিক দলকে ও কখন সবচেয়ে বেশি অনুদান দিয়েছে, তা জানা গেছে।
২০১৯ সালের ১২ এপ্রিল থেকে গত ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এসব বন্ড কিনে তা রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়েছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচনী বন্ড বিক্রি শুরু হওয়ার প্রথম বছরের হিসাব সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যে যুক্ত করা হয়নি।
বন্ডের মাধ্যমে সর্বোচ্চ অনুদান দেওয়া পাঁচটি শিল্পগোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের তিনটির কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি অনুদান পেয়েছে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। আর অন্য দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে সবচেয়ে বেশি অনুদান পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি)।
মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচারস লিমিটেড
উল্লিখিত সময়ের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচারস লিমিটেড। তবে সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি সবচেয়ে বেশি ৫৮৪ কোটি রুপি অনুদান পেয়েছে তেলেঙ্গানাভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান পামিরেড্ডি পিচি রেড্ডি ও তাঁর ভাতিজা পি ভি কৃষ্ণা রেড্ডি এই সময়ে ৯৬৬ কোটি রুপি অনুদান দিয়েছেন।
বিজেপির পর মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৯৫ কোটি রুপি অনুদান পেয়েছে কে চন্দ্রশেখর রাও নেতৃত্বাধীন ভারত রাষ্ট্র সমিতি (বিআরএস)। এ ছাড়া অন্ধ্র প্রদেশে ক্ষমতাসীন দল ওয়াই এস আর কংগ্রেসকে ৩৭ কোটি ও তামিলনাডুতে ক্ষমতাসীন দল ডিএমকে–কে ৮৫ কোটি রুপি অনুদান দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া নীতীশ কুমার নেতৃত্বাধীন বিহারে ক্ষমতাসীন জনতা দলকে (ইউনাইটেড) ১০ কোটি রুপি অনুদান দিয়েছে মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং।
নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অবশ্য বিরোধী দলগুলোকে অনুদান দিয়েছে। তবে এর পরিমাণ খুবই কম। প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে অন্ধ্র প্রদেশভিত্তিক টিডিপি ২৮ কোটি, কংগ্রেস ১৮ কোটি, জনতা দল (সেকুলার) ৫ কোটি ও জন সেনা পার্টি ৪ কোটি রুপি অনুদান পেয়েছে।
মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং যে সময়ের মধ্যে নির্বাচনী বন্ড কিনেছে, এ সময়ে সরকারি বেশ কিছু অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের কাজ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৪০০ কোটি রুপির থানে–বোরিভালি জোড়া টানেল প্রকল্পের কাজ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। উল্লেখ করার মতো বিষয় ২০২৩ সালের ১১ এপ্রিল ১৪০ কোটি রুপির নির্বাচনী বন্ড কেনার এক মাসের মাথায় এ প্রকল্পের কাজ পায় মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং। আর এই ১৪০ কোটি রুপির নির্বাচনী বন্ডের মধ্যে ১১৫ কোটি রুপিই অনুদান হিসেবে পেয়েছে বিজেপি। বাকি ২৫ কোটি অনুদান হিসেবে টিডিপি, জন সেনা পার্টি, কংগ্রেস ও জনতা দলের (সেকুলার) মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়।
ছোট একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এখন ভারতের অন্যতম বৃহৎ একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং। বর্তমানে ভারতের ২০টির বেশি রাজ্যে কাজ করে তারা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সরকারের বড় বড় প্রকল্পের কাজ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। অবশ্য বেশির ভাগ প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান মিলে ১ হাজার ২৩২ কোটি রুপির নির্বাচনী বন্ড কিনেছে। এর মধ্যে বিজেপি একাই পেয়েছে ৬৬৯ কোটি রুপি।
ফিউচার গেমিং ও হোটেল সার্ভিসেস প্রাইভেড লিমিটেড
একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে বেশি নির্বাচনী বন্ড কিনেছে ‘লটারি কিং’ নামে পরিচিত সান্তিয়াগো মার্টিনের প্রতিষ্ঠান ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড। উল্লিখিত সময়ের মধ্যে ১ হাজার ৩৬৮ কোটি রুপির বন্ড কিনেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে এর মধ্যে মাত্র ১০০ কোটি রুপি পেয়েছে বিজেপি।
নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি সবচেয়ে বেশি ৫৪২ কোটি রুপি অনুদান দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসকে। ফিউচার গেমিং থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫০৩ কোটি রুপি অনুদান পেয়েছে তামিলনাডুর ডিএমকে। এ ছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উল্লেখ করার মতো অনুদান পেয়েছে ওয়াই এস আর কংগ্রেস ১৫৪ কোটি রুপি ও কংগ্রেস ৫০ কোটি রুপি।
বেদান্ত
গতকাল স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া থেকে প্রকাশিত তথ্য–উপাত্তে দেখা গেছে, খনিজ সম্পদ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান বেদান্ত লিমিটেড এই সময়ে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপিকে ২৫০ কোটি রুপির বেশি অনুদান দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটের কেনা মোট বন্ডের মধ্যে অর্ধেকের বেশি পেয়েছে বিজেপি, যার অর্থমূল্য ৪০০ কোটি রুপির বেশি। নির্বাচনী বন্ড কেনার ক্ষেত্রে বেদান্তের অবস্থান চতুর্থ।
বিজেপির পর কংগ্রেসকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২৫ কোটি রুপি অনুদান দিয়েছে বেদান্ত। আর বিজু জনতা দল ৪০ কোটি ও ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা পেয়েছে ৫ কোটি রুপির অনুদান। এ ছাড়া বেদান্তের কাছ থেকে মাত্র ৩০ লাখ রুপি অনুদান পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস।
বেদান্ত লিমিটেড ভারতের খনি, তেল ও গ্যাস প্রকল্পের কাজে নিয়মনীতি ও পরিবেশবিধি লঙ্ঘন করে। ২০১৮ সালে ঝাড়খন্ডে একটি ইস্পাত কারখানা কিনে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। স্থানীয় লোকজন ও বেদান্তের নিরপত্তাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় গত নভেম্বরেও সেই কারখানা সংবাদের শিরোনাম হয়েছিল।
মহেন্দ্র কে জলন ও তাঁর পরিবার
কলকাতার শিল্পপতি মহেন্দ্র কে জলন ও তাঁর পরিবার তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬১৬ কোটি রুপির নির্বাচনী বন্ড কিনেছে। এই পরিবারের চারটি প্রতিষ্ঠান আছে। এই চার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কেনা বন্ডের মধ্যে অনুদান হিসেবে সবচেয়ে বেশি পেয়েছে বিজেপি, প্রায় ৩৫২ কোটি রুপি। এরপর কংগ্রেস ১৬০ কোটি ও তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে প্রায় ৬৬ কোটি রুপি।
২০১৩ সাল থেকেই বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেছেন মহেন্দ্র কে জলন। এর কিছুদিন পর নরেন্দ্র মোদি প্রথমবারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। পশ্চিমবঙ্গে মোদির সঙ্গে যেসব ব্যবসায়ীকে দেখা যেত, তাঁদের একজন ছিলেন জলন। একই সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও আয়োজনে দেখা গেছে তাঁকে।
কুইক সাপ্লাই চেইন প্রাইভেট লিমিটেড
নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপিকে ৩৭৫ কোটি রুপি অনুদান দিয়েছে কুইক সাপ্লাই চেইন প্রাইভেট লিমিটেড। এ ছাড়া মহারাষ্ট্রের ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টিকে (এনসিপি) ১০ কোটি ও শিবসেনাকে ২৫ কোটি রুপি অনুদান দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
ভারতের শীর্ষ ধনী মুকেশ আম্বানির প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্সের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে তালিকাভুক্ত না হলেও কুইক সাপ্লাই চেইনে রিলায়েন্সের প্রভাব যে অপরিসীম, সেটা দেখলেই বোঝা যায়। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান দুই পরিচালক বিপুল প্রাণলাল মেহতা ও তাপস মেহতা রিলায়েন্স অয়েল অ্যান্ড পেট্রোলিয়াম, রিলায়েন্স ইরোস প্রোডাকশনস, রিলায়েন্স ফটো ফিল্মস, রিলায়েন্স ফায়ার ব্রিগেডস, রাল ইনভেস্টমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড, রিলায়েন্স ফার্স্ট প্রাইভেট লিমিটেড, রিলায়েন্স পলিয়েস্টারসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের পরিচালক তাঁরা।
সঞ্জীব গোয়েঙ্কা গ্রুপ
নিজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কলকাতার শিল্পপতি সঞ্জীব গোয়েঙ্কা নির্বাচনী বন্ড কিনেছেন। প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি ৪২২ কোটি রুপি অনুদান হিসেবে পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২৭ কোটি রুপি অনুদান পেয়েছে বিজেপি। কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ১৫ কোটি।
সঞ্জীব গোয়েঙ্কার প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি বন্ড কিনেছে ২০২১ সালের মার্চ থেকে এপ্রিলের মধ্যে। এই সময়ে অনুষ্ঠিত হয় পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন। কাছাকাছি সময়ে কেরালা ও আসামেও বিধানসভা নির্বাচন হয়।
বিজেপি সরকার ২০১৮ সালে নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থা চালু করে। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল, এ ব্যবস্থায় নির্বাচনে কালো টাকার ব্যবহার বন্ধ করা। তবে ওই ব্যবস্থায় কে কোন দলকে কত টাকা দিচ্ছে, সে তথ্য গোপন রাখার কথা বলা ছিল। সরকার জানিয়েছিল, ওই তথ্য থাকবে একমাত্র এসবিআইয়ের কাছে। তা নিয়ে মামলা হয়। সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থা অসাংবিধানিক বলে বাতিল করেন। সেই সঙ্গে জানান, কে কোন দলকে কত চাঁদা দিচ্ছে, তা জানার অধিকার প্রত্যেক মানুষের রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট এ কথাও বলেছিলেন, এভাবে শাসক দলকে চাঁদা দিয়ে কোনো সংস্থা সরকারের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করতেই পারে। সেই সন্দেহ থেকে যায়। গণতন্ত্রের পক্ষে এ ব্যবস্থা শুভ নয়।