বিজেপির তৃণমূলে কি মোদি–অমিত শাহের কর্তৃত্ব কমে যাচ্ছে
মুখ বুজে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হুকুম বিজেপির রাজ্যস্তরের নেতারা আর মেনে চলছেন না। হরিয়ানা ও জম্মু–কাশ্মীর বিধানসভার নির্বাচনে টিকিট বিলি সেই প্রমাণ যেমন দিচ্ছে, তেমনই রাজ্যস্তরের নেতারাও ইদানীং প্রকাশ্যে তাঁদের বিরক্তি প্রকাশ শুরু করেছেন।
সর্বশেষ উদাহরণ ভারতের উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদের সাবেক বিজেপি সংসদ সদস্য লাল্লু সিং। দলের ডাকা সংবাদ সম্মেলন থেকে সম্প্রতি তিনি চলে যান মঞ্চে ‘মাফিয়ার’ উপস্থিতি সহ্য করতে না পেরে। যাঁকে তিনি ‘মাফিয়া’ বলেছেন, তিনি তাঁর দলেরই এক প্রতিষ্ঠিত নেতা।
ফৈজাবাদ আসনের মধ্যেই পড়ে অযোধ্যা। লাল্লু সিং সেখান থেকেই জিততেন। গত লোকসভা ভোটে ওই আসনে তিনি সমাজবাদী পার্টির কাছে হেরে যান। গোটা উত্তর প্রদেশেই বেশ খারাপ ফল করে বিজেপি। দলের ধারণা, অন্তঃকলহই খারাপ ফলের প্রধান কারণ।
চিন্তিত নেতৃত্ব অবস্থার সামাল দিতে উঠেপড়ে নামলেও তা যে অত্যন্ত দুরূহ, লাল্লু সিংয়ের আচরণে তা স্পষ্ট। দলের এই হাল বিজেপির কপালের ভাঁজ গাঢ় করেছে। কারণ, চলতি বছরেই রাজ্যে হতে চলেছে বিধানসভার ১০টি আসনের উপনির্বাচন। সেই আসনগুলোর একটি মিলকিপুর অযোধ্যাতেই।
উপনির্বাচনের আগে বিজেপি রাজ্যজুড়ে নতুন সদস্য সংগ্রহে জোর দিয়েছে। সেই উপলক্ষে অযোধ্যার সার্কিট হাউসে বৈঠক ডাকা হয়েছিল। বৈঠকের পর আয়োজন করা হয়েছিল সংবাদ সম্মেলনের। সেই মঞ্চে দলীয় নেতা শিবেন্দ্র সিংয়ের উপস্থিতি লাল্লু সিংকে বিস্মিত করে। মাফিয়ার উপস্থিতিতে তিনি মঞ্চে থাকতে পারবেন না জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন ছেড়ে চলে যান।
যাওয়ার আগে লাল্লু গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মাফিয়ার সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করতে পারব না। সারা জীবন মাফিয়াদের বিরুদ্ধে লড়েছি। দলীয় মঞ্চে তাদের উপস্থিতি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।’
শিবেন্দ্র সিংয়ের অতীত বিতর্কিত। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ ছিল। গ্যাংস্টার আইনে মামলা রুজু হয়েছিল। ২০১৮ সালে ফৈজাবাদ কারাগারেই তাঁকে বন্দি রাখা হয়েছিল। এখন তিনি দলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা।
২০২৪ সালের ভোটের আগে পর্যন্ত রাজ্যে রাজ্যে, জেলায় জেলায় এই ধরনের গোষ্ঠী কোন্দল এভাবে প্রকাশ্যে আসেনি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কঠোর থাকায় খোলাখুলি কেউ কারও সমালোচনা করতে পারত না। একের পর এক নির্বাচনে জয়ের ফলে দলের সর্বস্তরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর কর্তৃত্ব ছিল। তাঁদের নির্দেশ কেউ চ্যালেঞ্জ করার সাহস পেত না। লোকসভা নির্বাচনে আশানুরূপ ফল না হওয়ায় সেই কর্তৃত্ব এখন যে আর নেই, তা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। অযোধ্যাকাণ্ড তার প্রমাণ।
এই বিবাদ মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের পক্ষেও চিন্তার। লোকসভা ভোটে ভালো ফল না হওয়ায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁর ওপর প্রসন্ন নয়। রামমন্দির তৈরি সত্ত্বেও অযোধ্যায় বিজেপি হার সারা দেশে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। দলের একাংশ খারাপ ফলের জন্য মুখ্যমন্ত্রী যোগীকে যেমন দায়ী করছে, তেমনই যোগীর অনুগামীদের অভিযোগ, রাজ্যের মত উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় নেতারা প্রার্থী দেওয়াই হারের কারণ।
পারস্পরিক এই কলহের মধ্যেই এসে পড়ছে রাজ্যের ১০ বিধানসভা আসনের উপনির্বাচন। ওই সব আসনের মধ্যে পাঁচটি ছিল সমাজবাদী পার্টির দখলে, যার মধ্যে অযোধ্যার মিলকিপুর অন্যতম। সেখানকার বিধায়ক অবধেশ প্রসাদ বিজেপির লাল্লু সিংকে হারিয়ে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ওই আসনে উপনির্বাচন হবে।
মুখ্যমন্ত্রী যোগী এই আসন জিততে মরিয়া। বিজেপির অভ্যন্তরীণ জল্পনা, উপনির্বাচনে বিজেপি ও তার সহযোগীদের জয় সুনিশ্চিত করতে না পারলে যোগী আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে টিকে থাকা কঠিন হবে।
হরিয়ানা ও জম্মু–কাশ্মীর বিধানসভার নির্বাচন নিয়েও বিজেপি প্রবল চাপে। দুই রাজ্যেই প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে ক্ষোভ–বিক্ষোভ তীব্র। হরিয়ানায় বিক্ষুব্ধ নেতারা হয় দলত্যাগ করছেন, নতুবা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জম্মুতেও বিজেপির মধ্যে অসন্তোষ তীব্র।
দলীয় নেতাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিনের কর্মীদের মনোনয়ন না দিয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা গুরুত্ব দিচ্ছেন অন্য দল থেকে আসা নেতাদের। এমনকি পরিচিত ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরও’। এই দুই রাজ্যের ফল বিজেপির বিপক্ষে গেলে তার প্রভাব মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খন্ডের ভোটে পড়বে। যেমন পড়বে উপনির্বাচনগুলোতেও।