বিকল্প খুঁজছে রাশিয়ার অস্ত্রের বড় ক্রেতা ভারত
ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে একাধিক পশ্চিমা দেশ ও জোট। এমন পরিস্থিতিতে রাশিয়ার বাইরে অন্য উৎস থেকে অস্ত্র আমদানির খোঁজ করছে ভারত। দেশেই অস্ত্র তৈরি ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো থেকে অস্ত্র কেনার পরিকল্পনা করছে ভারত। দিল্লি এর মাধ্যমে রুশ অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে।
ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি সূত্র এবং দেশটি সরকারের দুই কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এসব কথা বলেছেন। তাঁরা বলেন, বিশাল সশস্ত্র বাহিনীর জন্য অস্ত্রের চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন উৎস থেকে অস্ত্র কেনার চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই করে আসছিল নয়াদিল্লি। এমনকি দেশেই অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করছিল।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অস্ত্রের চাহিদার একটি তালিকা দিয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, এ বছর ২ হাজার ৫১৫ কোটি রুপির প্রতিরক্ষাসরঞ্জামের প্রয়োজন হবে ভারতের। আর এ অস্ত্রের জন্য অন্য দেশের ওপর নির্ভরতা কমাতে চায় দেশটি।
ভারতীয় বিমানবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ অভিযানের নেতৃত্বে থাকা এয়ার মার্শাল বিভাস পান্ডে বলেন, ‘বর্তমান অশান্ত বিশ্বপরিস্থিতি ও ভূরাজনৈতিক অবস্থা আমাদের একটা শিক্ষা দিয়েছে।’
বিভান পান্ডে নয়াদিল্লিতে প্রতিরক্ষাসরঞ্জাম প্রস্তুতকারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘যদি আমরা নিশ্চয়তা ও স্থিতিশীলতা চাই, তাহলে আমাদের একমাত্র উপায় হলো সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীল অথবা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে দেশে প্রতিরক্ষাসরঞ্জাম সরবরাহব্যবস্থা তৈরি করা।’
তবে এসব কথা বলার সময় ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের প্রসঙ্গ তোলেননি বিভাস পান্ডে। তিনি বলেন, তিন বছরের মধ্যে ভারতীয় বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমানের টায়ার ও ব্যাটারি মাদ্রাজ রাবার ফ্যাক্টরির (এমআরএফ) মতো দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
দেশে অস্ত্র তৈরি নিয়ে ঊর্ধ্বতন এক সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, দেশেই অর্ধেক প্রতিরক্ষাসরঞ্জাম তৈরির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার।
প্রতিরক্ষাসরঞ্জাম নিয়ে মস্কোর ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা ও এর ওপর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে জানতে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে অবশ্য কোনো সাড়া পায়নি রয়টার্স।
নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ব্রহ্ম চেলানি বলেন, অতীতে রাশিয়ার প্রতিরক্ষাসরঞ্জামের ওপর ভারত নির্ভরশীল হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইসরায়েলের মতো দেশ থেকে আমদানি বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রতিরক্ষা ইস্যুতে এই স্থানান্তর ধীরগতিতে করতে হয়। রাতারাতি সরবরাহকারী বদল হওয়া সম্ভব নয়।
সুইডেনের স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) হিসাবে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ১৩ লাখ ৮০ হাজার। ভারত হলো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অস্ত্র আমদানিকারক। ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই খাতে ১ হাজার ২৪০ কোটি ডলার ব্যয় করেছে ভারত। এর মধ্যে শুধু রাশিয়া থেকেই ভারত ৫৫১ কোটি ডলারের অস্ত্র আমদানি করেছে।
রাশিয়ার তৈরি ট্যাংক ও কালাশনিকভ রাইফেল ব্যবহার করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। ভারতীয় বিমানবাহিনী ব্যবহার করে সুখোই যুদ্ধবিমান ও এমআই-১৭ পরিবহন হেলিকপ্টার। অন্যদিকে, দেশটির নৌবাহিনীর বহরে রয়েছে এর আগে রাশিয়ার নৌবহরে থাকা আইএনএস বিক্রমাদিত্য।
রয়টার্স বলছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ভারতের বেশ কিছু পশ্চিমা মিত্রদেশ প্রতিরক্ষাসরঞ্জাম সরবরাহ করার আগ্রহের কথা জানিয়ে নয়াদিল্লিকে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে।
ভারতের সীমান্তবর্তী দুই প্রতিবেশী দেশ চীন ও পাকিস্তান। দুই দেশের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ আছে ভারতের। দেশ দুটির সঙ্গে ভারত একাধিক যুদ্ধেও জড়িয়েছে। ভারত সরকারের দুই কর্মকর্তার একজন বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় ত্রিমুখী প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করছে ভারত।
পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশ ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর মতো অস্ত্র ও সরঞ্জাম ব্যবহার করে এবং এসব দেশ ভারতকে প্রতিরক্ষাসরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে পর্যালোচনা করছে দেশটির সরকার।
এসব তথ্য জানালেও ভারতের ওই কর্মকর্তা বিষয়টি সংবেদনশীল হওয়ায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রাশিয়ার অস্ত্র সরবরাহে টানাপোড়েন শুরু হলে আমাদের হাতে অন্য উপায় আছে।’ তিনি আরও বলেন, বেশ কিছু প্রতিরক্ষা চুক্তির জন্য রাশিয়ার সমকক্ষ দেশগুলোর প্রতি অস্ত্র সরবরাহের আহ্বানও জানিয়েছে ভারত। এর মধ্যে রয়েছে রাশিয়া এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা ও ভারতের উত্তরের নতুন একটি কারখানা থেকে ছয় লাখের বেশি কালাশনিকভ একে-২০৩ রাইফেল সরবরাহের চুক্তি।
দেশে প্রতিরক্ষাসরঞ্জাম তৈরির যে প্রচেষ্টা ভারত সরকার শুরু করেছে, তার প্রভাব এর মধ্যেই টের পেতে শুরু করেছে ভারতীয় কিছু প্রতিষ্ঠান।
ভারতের আদানি শিল্পগোষ্ঠী ও ইসরায়েল উইপন ইন্ডাস্ট্রিজের যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানি পিএলআর সিস্টেমস ভারতে ছোট ছোট অস্ত্র তৈরি করে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর পিএলআর সিস্টেমসের কাছ থেকে রাইফেল সরবরাহের চাহিদা অনেকটা বেড়ে গেছে।
সূত্রের বরাতে রয়টার্সের প্রতিবেদনে আরও বলা হচ্ছে, রাশিয়ার কালাশনিকভের বদলে ইসরায়েলি নকশা করা গালিল এসিই রাইফেল সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে পিএলআর সিস্টেমস।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সূত্র বলেছে, রাজ্যগুলো ও কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী থেকে রাইফেলের চাহিদা আসছে। কিন্তু এ মুহূর্তে অন্য কোনো দেশ থেকে তারা রাইফেল পাচ্ছে না।