ভাইরাসটির নাম যেভাবে ‘ডেঙ্গু’ হলো

বিশ্বের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে এডিস ইজিপটি ও এডিস অ্যালবোপিকটাস নামের বিশেষ প্রজাতির মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছবি: এএফপি ফাইল ছবি

ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকের দশকগুলোয় চিকিৎসকেরা বলতে থাকেন, বিশ্বজুড়ে নতুন একটি সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ফিলাডেলফিয়া, পুয়ের্তো রিকো, জাভা ও কায়রোর মানুষ এই ভাইরাসে অসুস্থ হচ্ছেন। তাঁরা জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন, পুরো শরীরে ব্যথা বোধ করছেন। চিকিৎসকেরা এর নাম দেন ‘ব্রেক–বোন ফিভার’ বা ‘হাড়ভাঙা জ্বর’।

১৮০১ সালে স্পেনের মাদ্রিদে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ে। স্পেনের তৎকালীন রানি মার এ লুইসা দে পারমা তখন এ রোগে আক্রান্ত হন। সুস্থ হওয়ার পর রানি একটি চিঠিতে তাঁর কিছু উপসর্গ সম্পর্কে লিখেছিলেন। তিনি যে রোগের বর্ণনা দিয়েছিলেন, সেটিই এখন আমাদের কাছে ‘ডেঙ্গু’ নামে পরিচিত।

চিঠিতে রানি লিখেছিলেন, ‘আমি আগের চেয়ে ভালো বোধ করছি। ঠান্ডা ভাবের রোগ হওয়ার কারণে তারা এটিকে ডেঙ্গু নামে ডাকছে।’

উপসর্গ সম্পর্কে রানি লিখেছেন, ‘গতকাল থেকে আমার শরীর থেকে কিছু রক্ত বের হওয়ায় অস্বস্তি হচ্ছিল। কিছুক্ষণ কথা বলার পর গলা ব্যথা করছিল।’

এখন আমরা জানি, ফ্লাভি ভাইরাস গোত্রের অন্তর্ভুক্ত এবং নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত চারটি ভাইরাসের কারণে ডেঙ্গু জ্বর হয়ে থাকে। বিশ্বের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে এডিস ইজিপটি ও এডিস অ্যালবোপিকটাস নামের বিশেষ প্রজাতির মশার মাধ্যমে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। প্রাকৃতিকভাবে যেখানেই এ মশার অস্তিত্ব আছে, সেখানেই এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। এতে অনেক মানুষ আক্রান্ত হতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও) নথিভুক্ত তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের প্রথম ৪ মাসে বিশ্বে ৭৬ লাখের বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে, যা ২০২৩ সালের পুরো বছরের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৩ সালে ৬৫ লাখ আক্রান্তের ঘটনা জানা গিয়েছিল। ২০২৪ সালের প্রথম চার মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

ডব্লিওএইচওর বৈশ্বিক ডেঙ্গু নজরদারির ব্যবস্থার আওতায় নথিভুক্ত হওয়া তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ের শুরু নাগাদ ৯৬ লাখ ডেঙ্গু আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। একই সময়ে বিশ্বব্যাপী ৫ হাজার ৩৬৬ মানুষ মারা গেছে। ২০২৩ সালে বিশ্বে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৭ হাজার ৩০০ মানুষের মৃত্যু হয়।

গত পাঁচ বছরে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দ্রুতগতিতে বাড়তে দেখা গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং এল নিনোর প্রভাবে উষ্ণতা ও আর্দ্রতা বেশি হওয়ায় এ ভাইরাস বহনকারী কীটপতঙ্গগুলো নতুন নতুন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। রোগের সংক্রমণ বাড়ছে।

২০২৪ সালে ৯০টি দেশে ডেঙ্গুর ভাইরাস সক্রিয়ভাবে ছড়াতে দেখা গেছে। ৩১টি দেশের কর্তৃপক্ষ বলেছে, সেখানে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। বিশেষ করে আমেরিকার দেশগুলোয় অনেক বেশি হারে আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে। ২০২৪ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) দেশটিতে ডেঙ্গু ভাইরাসের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি সম্পর্কে একটি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করে।

ডেঙ্গুর নামকরণ যেভাবে

কীভাবে ডেঙ্গুর নামকরণ হলো, তা খতিয়ে দেখতে বিশ্বে ভাইরাসের নামকরণের প্রবণতার দিকে দৃষ্টি দিতে হয়। এতে দেখা গেছে, বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে বিশ্বে ভাইরাসের নামকরণ হয়েছে, যা অগোছালো। কখনো কখনো উপসর্গের ধরন অনুযায়ী অনেকগুলো ভাইরাসের নামকরণ হয়েছে।

কোনো কোনো ভাইরাসকে তাদের উৎপত্তিস্থল, এমনকি যে পশুর মধ্যে প্রথম তাদের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, সে পশুর নাম অনুযায়ী নামকরণ হয়েছে। আবার এমন অনেক ভাইরাস আছে, যেগুলোর ব্যুৎপত্তিগত তথ্যই হারিয়ে গেছে। বিভিন্ন বিশ্লেষণী কৌশল ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এখন ভাইরাস শনাক্ত করার কাজটি সহজ হয়েছে। আর সে কারণে চেনাজানা ভাইরাসের নামের তালিকা ক্রমাগত দীর্ঘ হচ্ছে।

বিশ্বের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে এডিস ইজিপটি ও এডিস অ্যালবোপিকটাস নামের বিশেষ প্রজাতির মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে
ছবি: এএফপি ফাইল ছবি

নামকরণের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনতে বিজ্ঞানীরা এখন পদ্ধতিগত নামকরণের ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছেন, যেন এতে উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাসকে শনাক্ত ও নামকরণ করা যায়।

ঠিক কীভাবে ডেঙ্গু জ্বরের নামকরণ হলো, তা নিয়ে একেবারে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এটি উপসর্গের সঙ্গে সম্পর্কিত।

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মানুষের মনে হয়, তাদের হাড় ও পেশি কুঁকড়ে যাচ্ছে। এতে তাদের চলাফেরা করাটা যন্ত্রণাদায়ক হয়।

একটি তত্ত্ব অনুসারে, সোয়াহিলি ভাষায় ডেঙ্গুকে ‘কি ডেঙ্গা পেপো’ বলে ডাকা হতো। এর সূত্র ধরেই পরবর্তী সময় স্প্যানিশ ভাষায় ডেঙ্গু নামটি প্রচলিত হয়। কি ডেঙ্গা পেপোর অর্থ হলো হঠাৎই অশুভ আত্মা চেপে বসা। অন্য একটি তত্ত্ব বলছে, ক্যারিবীয় অঞ্চলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী বেশি পাওয়া যেত। ক্যারিবীয় অঞ্চলের লোকজন একে ড্যান্ডি বলে উচ্চারণ করত। হতে পারে, সেখান থেকেই ডেঙ্গুর নামকরণ হয়েছে। আবার স্প্যানিশ ডেঙ্গেরু শব্দ থেকেও এটি আসতে পারে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষের চলাফেরার কষ্ট বোঝাতে স্পেনে ডেঙ্গেরু শব্দটি ব্যবহার করা হতো।

ভাইরাসের নামকরণ নিয়ে বিভ্রান্তি

বর্তমানে ১৪ হাজার ৬৯০টি পরিচিত ভাইরাস প্রজাতি আছে, যেগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে নামকরণ করা হয়েছে। তবে পৃথিবীতে কতগুলো ভিন্ন ভিন্ন ভাইরাস আছে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের নিশ্চিত ধারণা নেই।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শুধু স্তন্যপায়ী প্রাণীরাই ৩ লাখ ২০ হাজার ভাইরাসের আশ্রয়স্থল। মানুষের অন্ত্রসংক্রান্ত আরেকটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ১ লাখ ৪০ হাজার ব্যাকটেরিওফেজ আছে। এগুলো এমন এক ধরনের ভাইরাস, যা ব্যাকটেরিয়া কোষকে সংক্রমিত করে।

এখন পর্যন্ত জানা তথ্য অনুযায়ী, মানবজাতিকে আক্রান্ত করে—এমন ২৭০ ধরনের ভাইরাস আছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। সারস-কভ-২, জিকা ভাইরাস ও এমপক্সের মতো ভাইরাসগুলোর কারণে নতুন নতুন সংক্রামক রোগ দেখা দিচ্ছে।

ডেঙ্গু ভাইরাস হেমোরেজিক ফিভার নামের একটি ভাইরাস গোত্রের অন্তর্গত। অনেক ক্ষেত্রেই মশার কামড়ের মাধ্যমে রোগটি ছড়ায়। আবার কিছু ক্ষেত্রে অন্য কীটপতঙ্গ এবং কখনো কখনো বাদুড়ের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মাধ্যমে ভাইরাল হেমোরেজিক ফিভার বা জ্বর ছড়াতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত অন্য ব্যক্তির শরীরে ঢুকলে কিংবা আক্রান্তের শরীরের নিঃসৃত রসের সংস্পর্শে আসার মধ্য দিয়ে মানুষ থেকে মানুষেও সংক্রমণ ছড়ায়।

এ রোগের লক্ষণগুলোর মধ্যে আছে উচ্চ তাপমাত্রা, তীব্র মাথাব্যথা, অস্থিসন্ধি ও পেশিতে ব্যথা, ডায়রিয়া ও বমি, সেই সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্তপাত ও ক্ষত। আক্রান্ত ব্যক্তিদের সবার মধ্যেই যে উপসর্গগুলো দেখা যাবে, তা নয়। তবে ভাইরাল হেমোরেজিক জ্বর খুব খারাপ হতে পারে। এর মধ্যে আছে ইবোলা, নিপাহ ও মারবার্গ ভাইরাস। এসব ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুর হার বেশি।

আরও একটি মশাবাহিত রোগ আছে, যা ভাইরাল হেমোরেজিক ফিভার গোত্রের অন্তর্গত। এটি যকৃৎকে আক্রান্ত করে। এতে রোগীর দেহে জন্ডিস দেখা দেয়। এই রোগ ‘ইয়েলো ফিভার’ নাম পরিচিত।

তবে রোগের উপসর্গের ভিত্তিতে ভাইরাসের নামকরণের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থেকে যাচ্ছে। কারণ, বিভিন্ন রোগের উপসর্গ কাছাকাছি হতে পারে।

যে জায়গায় বা যে প্রাণীর শরীরে ভাইরাসের অস্তিত্ব প্রথম পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে ওই নির্দিষ্ট ভাইরাসের নামকরণের ক্ষেত্রেও বিভ্রান্তি হতে পারে। যেমন এমপক্স এমন একটি রোগ, যা কোনো প্রাণীর শরীর থেকে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। এটি জুনোসিস নামে পরিচিত।

২০২২ সাল পর্যন্ত এটি মাঙ্কিপক্স নামে পরিচিত ছিল। বানরের শরীরে প্রথম পাওয়া যাওয়ায় এমন নামকরণ করা হয়েছিল। পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নামটি পরিবর্তন করে ‘এমপক্স’ করার সুপারিশ করে।

মাঙ্কিপক্স নামকরণের ক্ষেত্রেও বিতর্ক আছে। গবেষণার জন্য আফ্রিকা থেকে ইউরোপে আমদানি করা বানরের মধ্যে প্রথম এ ভাইরাস পাওয়া যাওয়ায় এমন নামকরণ হয়েছিল।

কিন্তু বানর আসলে এই ভাইরাসের প্রাকৃতিক ধারক-বাহক নয়, তারা ঘটনাচক্রে হওয়া ধারক। আফ্রিকার এক বিশেষ ধরনের কাঠবিড়ালিসহ ইঁদুরজাতীয় প্রাণী এই ভাইরাসের প্রাকৃতিক ধারক-বাহক।