বাংলাদেশসহ বিশ্বের যেসব দেশের মানুষের গড় উচ্চতা সবচেয়ে কম

বিশ্বে মানুষের গড় উচ্চতা ১৬৬ দশমিক ৯৯ সেন্টিমিটার বা প্রায় সাড়ে ৫ ফুট। তবে অঞ্চল বা দেশভেদে মানুষের উচ্চতা বিভিন্ন রকমের হয়। যেমন- নেদারল্যান্ডসের মানুষের গড় উচ্চতা ১৭৭ দশমিক ০৭ সেন্টিমিটার (৫ ফুট ৯ দশমিক ৭ ইঞ্চি), যা বৈশ্বিক গড় উচ্চতার চেয়ে ১০ সেন্টিমিটার বেশি। আবার বিশ্বে এমন কিছু দেশ আছে, যেখানকার মানুষের গড় উচ্চতা বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে ১০ সেন্টিমিটার কম।

মানুষের উচ্চতা কম হওয়ার পেছনে জিনগত কারণের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক কিছু বিষয়েরও ভূমিকা থাকে। ওয়ার্ল্ড এটলাসে দেওয়া তালিকা থেকে পাঠকদের জন্য সেই তালিকা তুলে ধরা হলো।

পূর্ব তিমুর

পূর্ব তিমুরের মানুষের গড় উচ্চতা ৫ ফুট ১ দশমিক ৬ ইঞ্চি
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ পূর্ব তিমুরে বিশ্বের সবচেয়ে কম উচ্চতার মানুষের বসবাস। সেখানকার মানুষের গড় উচ্চতা মাত্র ১৫৬ দশমিক ৪২ সেন্টিমিটার (৫ ফুট ১ দশমিক ৬ ইঞ্চি)। দেশটির জনসংখ্যাও কম। সেখানে মাত্র ১৩ লাখ ৯০ হাজার মানুষ বাস করে। প্রায় ৩৫ হাজার বছর আগে নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষেরা এখানে বসতি শুরু করে। অস্ট্রোনেশিয়ান শিকারি জনগোষ্ঠীর পর এশীয় অভিবাসীরা সেখানে বসতি স্থাপন শুরু করে। কয়েক শতাব্দী ধরে অসংখ্য ছোট রাজ্য গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে দেশটি বিভক্ত হয়েছে। এর ফলে দেশটিতে ভাষা সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ মিশ্রণ দেখা যায়। বর্তমানে দেশজুড়ে ৩০টির বেশি ভাষায় কথা বলে মানুষ। গ্রামীণ পরিবারগুলোর একটা বড় অংশ চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেকেই প্রয়োজনীয় খাবার জোগাড় করতে পারে না। এতে দেশটিতে অপুষ্টি একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানকার পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৪৭ শতাংশ শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয় না।

গুয়াতেমালা

কম উচ্চতার মানুষের দিক থেকে বিশ্বে গুয়াতেমালার অবস্থান দ্বিতীয়
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

কম উচ্চতার মানুষের দিক থেকে বিশ্বে গুয়াতেমালার অবস্থান দ্বিতীয়। মধ্য আমেরিকার এ দেশটির মানুষের গড় উচ্চতা ১৫৭ দশমিক ৬৪ সেন্টিমিটার (৫ ফুট ২ দশমিক ১ ইঞ্চি)। জাতিগত বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ গুয়াতেমালার জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৬৫ লাখ ৬০ হাজার। এখানকার জনসংখ্যার প্রায় ৪২ শতাংশ আদিবাসী। মটরশুঁটি, ভুট্টা এবং মরিচ গুয়াতেমালার প্রধান খাবার। কাঠামোগত অসমতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটকে কেন্দ্র করে এখানকার মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে। বিশ্বের যেসব দেশের মানুষ দীর্ঘস্থায়ীভাবে অপুষ্টিতে ভোগে, তার তালিকায় গুয়াতেমালার অবস্থান ষষ্ঠ। দেশটির পুরুষ ও নারীদের ওপর এ অপুষ্টির প্রভাব পড়ে। শিশুদের কারও কারও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ে।

লাওস

কম উচ্চতার মানুষের বসবাসের দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ লাওসের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। সেখানকার মানুষের গড় উচ্চতা ১৫৭ দশমিক ৯৪ সেন্টিমিটার (৫ ফুট ২ দশমিক ২ ইঞ্চি)। বর্তমানে দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ৭৬ লাখ ৬০ হাজার। বিংশ শতাব্দীর আগে লাওসে ৬০টি ভিন্ন ভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস ছিল। তবে বর্তমানে লাও জনগোষ্ঠীর মানুষের প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। দেশটির প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষই লাও জনগোষ্ঠীর। লাওদের মধ্যে প্রায় ১৮ লাখ মানুষ, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় এক–চতুর্থাংশ অপুষ্টিতে ভুগছে। এর অন্যতম কারণ দারিদ্র্য।

নেপাল

কম উচ্চতার মানুষের দিক থেকে বিশ্বে নেপালের অবস্থান চতুর্থ
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

দক্ষিণ এশিয়ার দেশ নেপালের মানুষের গড় উচ্চতা ১৫৮ দশমিক ৩৮ সেন্টিমিটার (৫ ফুট ২ দশমিক ৪ ইঞ্চি)। কম উচ্চতার মানুষের দিক থেকে বিশ্বে দেশটির অবস্থান চতুর্থ। নেপালে ২ কোটি ৯৮ লাখ ৭০ হাজার মানুষের বসবাস। ইন্দো-আর্য এবং তিব্বতি গোষ্ঠীর মানুষেরা ব্যাপকভাবে ওই এলাকায় বসতি গড়ে তোলায় সেখানে জাতিগত বৈচিত্র্য দেখা যায়। নেপালের মানুষেরা সাধারণত গম, ভাত, মসুর ডাল এবং ভুট্টা খেয়ে থাকে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, ভৌগোলিক চ্যালেঞ্জ এবং পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতির মতো সামাজিক সমস্যাগুলোর কারণে দেশটির অনেক মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে। সেখানকার ৩৬ শতাংশ শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি হচ্ছে না।

বাংলাদেশ

বাংলাদেশের মানুষের গড় উচ্চতা ১৫৮ দশমিক ৭৩ সেন্টিমিটার বা ৫ ফুট আড়াই ইঞ্চি
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

বাংলাদেশের মানুষের গড় উচ্চতা ১৫৮ দশমিক ৭৩ সেন্টিমিটার (৫ ফুট আড়াই ইঞ্চি)। কম উচ্চতার মানুষের দিক থেকে এ দেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। আর জনসংখ্যাবহুল দেশের তালিকায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। নৃতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশের একটা বড় অংশই অভিন্ন। এখানকার ৯৯ ভাগ মানুষ বাঙালি। বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য ভাত। ভাতের সঙ্গে প্রোটিনের উৎস মাছও খাওয়া হয়ে থাকে। খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি এখানে বিশেষভাবে উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এখানকার ৩৫ শতাংশ মানুষ পর্যাপ্ত খাবার খেতে পায় না। এতে পাঁচ কিংবা তার চেয়ে কম বয়সী ২৮ শতাংশ শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে না।

মাদাগাস্কার

মাদাগাস্কারের তিন-চতুর্থাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

পূর্ব আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্র মাদাগাস্কারের মানুষের গড় উচ্চতা ১৫৯ দশমিক ১১ সেন্টিমিটার (৫ ফুট ২ দশমিক ৬ ইঞ্চি)। এখানকার জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৮ লাখ ৫০ হাজার। মাদাগাস্কারের ৯০ শতাংশ মানুষ মালাগাসি জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। মাদাগাস্কারের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। এর পাশাপাশি অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের খাবার খেতে দেখা যায়। মাদাগাস্কারের তিন-চতুর্থাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং অপুষ্টি অনেক শিশুর বৃদ্ধির ওপর প্রভাব ফেলে। পাঁচ বছরের কম বয়সী ১৮ লাখ শিশু (৪৭ শতাংশ) দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টিতে ভোগে এবং তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়।

ইয়েমেন

কম উচ্চতার মানুষের দিক থেকে পশ্চিম এশিয়ায় ইয়েমেনের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। দেশটির মানুষের গড় উচ্চতা ১৫৯ দশমিক ৫৯ সেন্টিমিটার (৫ ফুট ২ দশমিক ৮ ইঞ্চি)। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দী থেকে মানুষ ইয়েমেনে বসবাস করছে। বর্তমানে, ইয়েমেনের নাগরিকেরা মূলত আরব এবং আফ্রো-আরব বংশোদ্ভূত। দেশটির মানুষের প্রধান খাদ্যের মধ্যে আছে- ভুট্টা, বাজরা, গম, বার্লিসহ বেশ কয়েকটি শস্য। ভেড়া, ছাগল এবং মুরগি প্রোটিনের সাধারণ উৎস। চলমান সংঘাত, অস্থিতিশীল অর্থনীতি এবং পর্যাপ্ত সামাজিক সহায়তা না থাকায় দেশটির মানুষের অপুষ্টির হার ক্রমাগত বাড়ছে। দেশটির পাঁচ বছরের কর্ম বয়সী ৪৯ শতাংশ শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

ফিলিপাইন

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র ফিলিপাইনের মানুষের গড় উচ্চতা ১৫৯ দশমিক ৬৯ সেন্টিমিটার বা ৫ ফুট ২ দশমিক ৯ ইঞ্চি
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র ফিলিপাইনের মানুষের গড় উচ্চতা ১৫৯ দশমিক ৬৯ সেন্টিমিটার বা ৫ ফুট ২ দশমিক ৯ ইঞ্চি। কম উচ্চতার মানুষের দিক থেকে বিশ্বে এর অবস্থান অষ্টম। ফিলিপাইনের বাসিন্দাদের বড় অংশেরই পূর্বসূরিরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে এসেছেন। তাঁরা মালয় বংশোদ্ভূত। তাঁরা যে অঞ্চল থেকে এসেছেন, সেটি এখন ইন্দোনেশিয়া নামে পরিচিত। ভাত দেশটির প্রধান খাদ্য। ভাতের সঙ্গে সাধারণত মাছ, মাংস ও সবজি খাওয়া হয়ে থাকে। মা-বাবার মধ্যে স্বাস্থ্যবিষয়ক জ্ঞানের ঘাটতি এবং চরম দারিদ্র্যের কারণে দেশটির পাঁচ বছর বয়সী প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শিশুর মধ্যে উচ্চমাত্রার অপুষ্টি দেখা যায়। যেখানে দেশের পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ স্তব্ধ।

মোজাম্বিক

দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকে মানুষের গড় উচ্চতা ১৫৯ দশমিক ৮৬ সেন্টিমিটার (৫ ফুট ২ দশমিক ৯৪)। কম উচ্চতার মানুষের দিক থেকে এটির অবস্থান বিশ্বে নবম। এখানকার জনসংখ্যা আনুমানিক ৩ কোটি ৬৭ লাখ ৭০ হাজার। এখানে জাতিগত গোষ্ঠীর বৈচিত্র্য আছে। তবে মাকুয়া গোষ্ঠীর মানুষের প্রভাবটা এখানে বেশি। ভুট্টা এবং ভুট্টার আটা দিয়ে তৈরি খাবার সিমা, কাসাভা ও ভাত এখানকার অন্যতম প্রধান খাদ্য। অনেক মানুষই কার্বোহাইড্রেট-সমৃদ্ধ এসব খাবারের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হওয়ায় দেশটিতে অনেককে অপুষ্টিতে ভুগতে দেখা যায়। দেশটির ২০ লাখ তথা ৪৩ শতাংশ শিশু দীর্ঘ মেয়াদে উচ্চমাত্রার অপুষ্টিতে ভুগছে।

১০

সলোমন দ্বীপপুঞ্জ

অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ওশেনিয়ায় অবস্থিত সোলোমন দ্বীপপুঞ্জের মানুষের গড় উচ্চতা ১৫৯ দশমিক ৯৩ সেন্টিমিটার বা ৫ ফুট ২ দশমিক ৯৬ ইঞ্চি। কম উচ্চতার মানুষের দিক থেকে এটির অবস্থান বিশ্বে দশম। এখানকার জনসংখ্যা মাত্র ৮ লাখ ১৫ হাজার ৫০০। তাদের বেশির ভাগই মেলানেশিয়ান বংশোদ্ভূত। অল্প সংখ্যায় পলিনেশিয়ান বংশোদ্ভূত মানুষেরাও আছেন। মাছ দেশটির অন্যতম প্রধান খাবার। পাশাপাশি ভাত, মিষ্টি আলু এবং শাকসবজিও খাওয়া হয়। ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সোলোমন দ্বীপপুঞ্জে অপুষ্টির হার ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে আছে কৃষিজীবী পরিবারগুলো। কৃষক পরিবারগুলোর এক পঞ্চমাংশের কাছেই পর্যাপ্ত খাবার কেনার মতো অর্থসম্পদ থাকে না।