সেভেরোদোনেৎস্কের দখল হারিয়ে ইউক্রেনের কতটা ক্ষতি
পূর্ব ইউক্রেনের সেভেরোদোনেৎস্ক শহর রাশিয়ার কাছে কৌশলগত কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কয়েক সপ্তাহ ধরে তীব্র হামলা চালিয়ে শহরটির বেশির ভাগ এলাকা দখলে নিয়েছিল রুশ বাহিনী। এরই মধ্যে গত শুক্রবার সেখানে অবস্থান করা ইউক্রেনের সেনারা পিছু হটেছেন। এ কারণে শহরটি পুরোপুরি এখন রাশিয়ার দখলে। সমরবিদেরা বলছেন, সেভেরোদোনেৎস্কের নিয়ন্ত্রণ ইউক্রেনের চেয়ে রাশিয়ার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
২০১৪ সালে ইউক্রেনে মস্কো সমর্থিত সরকারের পতন হলে দেশটির লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চলের দখল নেয় রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। এই দুই অঞ্চলের বেশির ভাগ শহরই তাদের দখলে ছিল। লুহানস্কের হাতে গোনা যে কয়টি শহর রুশপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না, সেগুলোর একটি সেভেরোদোনেৎস্ক। এ কারণেই শহরটি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল ক্রেমলিন।
রাশিয়ার হামলায় সেভেরোদোনেৎস্কে ইউক্রেনীয় সেনাদের বেশির ভাগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সাবেক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ইহর রোমানেঙ্কো। তিনি বলেন, প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহরটির নিয়ন্ত্রণ হারানো ইউক্রেনের জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, পাশেই লিসিচানস্ক শহর এখনো ইউক্রনীয়দের দখলে।
সেভেরোদোনেৎস্কের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা ও আবাসিক এলাকা রকেট উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা, বোমারু বিমান, এমনকি সেকেলে ‘তোচকা ইউ’ ক্রিজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে তছনছ করেছে রুশ বাহিনী। গত শুক্রবার একই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন শহরটির কর্মকর্তা রোমান রোমান ভ্লাসেঙ্কোও। বলেন, ‘(রাশিয়ার) বিমান হামলা কাজে দিচ্ছে, তোচকা ইউ কাজে দিচ্ছে। রাশিয়া কামানের পুরো বহর যুদ্ধের ময়দানে নামিয়েছে। তারা চারদিক দিয়ে এগিয়ে আসছে।’
একই মত রাশিয়া ও পশ্চিমা অনেক বিশ্লেষকের। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযান শুরুর পর থেকেই নজরদারি করছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ওয়্যার। তাদের ভাষ্যমতে, একটি ভূখণ্ড রাশিয়ার সেনাদের দখলে চলে গেছে, এ দিক দিয়ে বিবেচনা করলে হয়তো সেভেরোদোনেৎস্কে ইউক্রেনের পরাজয় হয়েছে। তবে শহরটিতে যুদ্ধে যে রাশিয়ার বিজয় হয়েছে—এমনটি কিন্তু বলা যাবে না।
কারণ, সেভেরোদোনেৎস্কের দখল নিয়ে গত দুই মাসের লড়াইয়ে রুশ বাহিনীর উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শহরটিতে যুদ্ধ শুরু আগে জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জেমসটাউন ফাউন্ডেশনের বিশেষজ্ঞ পাভেল লুজিনের মতে, সেভেরোদোনেৎস্ক থেকে পিছু হঠার আগে রাশিয়ার অনেক সেনাকে হত্যা করেছে ইউক্রেনীয়রা।
সেভেরোদোনেৎস্ক শহরটির অবস্থান সিভেরস্কি দোনেৎস নদীর তীরে। এর আগেও শহরটিতে প্রবেশের চেষ্টা করেছে রুশ বাহিনী। তবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে তখন পিছু হঠতে হয়েছিল। এবার কামানের সক্ষমতার দিক দিয়ে এগিয়ে থাকায় রাশিয়া শহরটি দখল করতে পেরেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।
কিয়েভ নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো মূলত কৃষিজমি। ওই এলাকার মধ্যে সেভেরোদোনেৎস্ক, লিসিচানস্ক ও রুবিঝনে শহরে শুধু একটি রাসায়নিক কারখানা ও সেলুলোজ কারখানা রয়েছে। তবে রাশিয়ার হামলায় এসব কারখানা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক আলেকসি কুশচ। আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, লুহানস্ক দখল হলে ইউক্রেনের ওপর এর সামান্যই প্রভাব পড়বে।
সেভেরোদোনেৎস্কের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা ও আবাসিক এলাকা রকেট উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা, বোমারু বিমান, এমনকি সেকেলে ‘তোচকা ইউ’ ক্রিজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে তছনছ করেছে রুশ বাহিনী। শুক্রবার একই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন শহরটির কর্মকর্তা রোমান রোমান ভ্লাসেঙ্কোও। তিনি বলেন, ‘(রাশিয়ার) বিমান হামলা কাজে দিচ্ছে, তোচকা ইউ কাজে দিচ্ছে। রাশিয়া কামানের পুরো বহর যুদ্ধের ময়দানে নামিয়েছে। তারা চারদিক দিয়ে এগিয়ে আসছে।’
সেভেরোদোনেৎস্কের পতনের পর এবার হয়তো পাশের লিসিচানস্ক শহর রাশিয়ার দখলে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে এতে করে হয়তো পুরো লুহানস্ক রাশিয়ার দখলে যাবে। তবে এর মধ্য দিয়ে পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যে জয় চান তা পাবেন না।
ইউক্রেনের হামলা শুরুর পর রাজধানী কিয়েভসহ দেশটির উত্তরাঞ্চল দখলে ব্যর্থ হয় রাশিয়া। তাদের ক্ষতির পরিমাণটাও ছিল চোখে পড়ার মতো। এসবের মধ্যে এপ্রিলের প্রথম দিকে এসব অঞ্চল থেকে রুশ সেনাদের সরিয়ে নেওয়া হয়। পুতিন ঘোষণা দেন, এখন রাশিয়ার লক্ষ্য পূর্ব ইউক্রেনের দনবাসের লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চলের পুরোটা দখল নিতে নজর দেওয়া।
এরপর থেকে পূর্ব ইউক্রেনে হামলা জোরদার করেছে রাশিয়া। এরপরও এই মুহূর্তে দোনেৎস্কের পাঁচ ভাগের অন্তত দুই ভাগ এলাকা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর দখলে। ২০১৪ সালের পর থেকে এসব এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করেছে তারা। ফলে লুহানস্কের চেয়ে দোনেৎস্কের দখল নেওয়ার রাশিয়ার জন্য অনেক বেশি কঠিন হবে।
এদিকে পুরো লুহানস্কের নিয়ন্ত্রণা হারানোর অর্থনৈতিক প্রভাব ইউক্রেনকে তেমন একটা ভোগাবে না বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। কারণ, ২০১৪ সাল থেকেই লুহানস্কের বেশির ভাগ কারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র ও কয়লা খনিগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে রয়েছে।
কিয়েভ নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো মূলত কৃষিজমি। ওই এলাকার মধ্যে সেভেরোদোনেৎস্ক, লিসিচানস্ক ও রুবিঝনে শহরে শুধু একটি রাসায়নিক কারখানা ও সেলুলোজ কারখানা রয়েছে। তবে রাশিয়ার হামলায় এসব কারখানা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক আলেকসি কুশচ। আল–জাজিরাকে তিনি বলেন, লুহানস্ক দখল হলে ইউক্রেনের ওপর এর সামান্যই প্রভাব পড়বে।
আলেকসি কুশচ বলেন, লুহানস্কের চেয়ে বরং ইউক্রেন নিয়ন্ত্রিত দোনেৎস্কের প্রশানসিক রাজধানী মারিউপোলের দখল রাশিয়ার হাতে যাওয়ায় ক্ষতি হয়েছে বেশি। কারণ, শহরটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর এবং সেখানে দুটি বিশাল ইস্পাত কারখানা রয়েছে। ইউক্রেনের রপ্তানি করা ইস্পাতের বড় একটি অংশ এই দুটি কারখানায় উত্পাদন করা হতো।
বিশ্লেষকদের মতে, সেভেরোদোনেৎস্কে যুদ্ধ এটাই দেখিয়েছে যে, হয়তো শিগগিরই ইউক্রেনের সেনারা সক্ষমতার দিক দিয়ে রাশিয়ার সেনাদের সমতায় চলে যাবে। কারণ, রুশ বাহিনী তাদের সংরক্ষিত সেনা, অস্ত্রশস্ত্র ও মনোবল হারাচ্ছে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সাবেক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ইহর রোমানেঙ্কো বলেন, ‘রাশিয়ার সেনারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।’