শোকের ফুল চন্দ্রমল্লিকা
বেদনার আর্তি মেশানো হেমন্তের পশলা পশলা তির্যক বৃষ্টি শীতের আগমনী বার্তা দিচ্ছে ফ্রান্সে। তাপমাত্রা ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে। ফরাসিরা ভারী ভারী শীতবস্ত্র গায়ে চাপতে শুরু করে দিয়েছে। ধূসর আকাশে ছাইরঙা মেঘের পুরো চাদর মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিষণ্নতার অদৃশ্য চাদরটিকে উসকে দিচ্ছে। নগরীর প্রাণচাঞ্চল্য অনেকটাই থমকে গেছে, সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা—শান্ত একটা ভাব চারদিকে। যেখানে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে আছে আত্মজনেরা, তাদের সমাধি বেদিতে ফুল সাজাবার জন্য অনেকেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে গেছে সেখানে। নভেম্বর মাসের ১ তারিখ ফ্রান্সে প্রতি বছর ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয় পরলোকগত স্বজনদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। এ দিন সমাধি বেদিতে নিবেদন করা হয় চন্দ্রমল্লিকা ফুল। ১ নভেম্বর তাই চন্দ্রমল্লিকার দিন।
ফরাসিদের ধর্মীয় ও জাতীয় জীবনে নভেম্বরের প্রথম দিনটি ‘তুসাঁ’ (Toussaint ; All Saints’ Day) নামে পরিচিত। এ দিনটি সকল সাধু সন্তের দিন। আবার এই দিনটিতেই পালন করা হয় ‘ফেত দে মর্’—এর বাংলা অর্থ হচ্ছে পরলোকগত আত্মজনের স্মরণ-দিবস। যদিও এই দিনটি পালনে বাইবেলে কোনো নির্দেশনা নেই। পঞ্চম শতাব্দীর প্রথমদিকে রোমে এ দিনটি পালন করা হতো। তবে ১৩ মে ৬১০ তারিখে পোপ চতুর্থ বনিফেস প্রথমবারের মতো এ দিনটিকে উদ্যাপন করেন। সেই থেকে প্রতি বছর ১৩ মে মৃতের দিবস হিসেবে উদ্যাপন করা হতো। এর এক শতাব্দী পরে, পোপ তৃতীয় গ্রেগরি নভেম্বরের এক তারিখে এ দিনটি উদ্যাপনের জন্য চূড়ান্ত করেন।
সেই থেকে আজ অবধি ফ্রান্স এবং আরও বহু দেশে এ দিনে মৃত ব্যক্তিদের বেশ আড়ম্বরের সঙ্গে স্মরণ করা হয়। বিশেষ করে ফ্রান্সে এ দিনটির সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে চমৎকার ফুল চন্দ্রমল্লিকা। ফরাসি প্রথা ও সংস্কারে চন্দ্রমল্লিকা হলো শুধু পরলোকগত স্বজনদের জন্য। তাই এর ঠাঁই হয় না ঘরে, উপহার দেওয়া হয় না অন্য কাউকে। ফরাসি মানসিকতায় চন্দ্রমল্লিকা সমাধির ফুল, শোকের স্মারক, পবিত্র পুষ্পাঞ্জলি।
আজকের এই দিনটিতে উপচে পড়া ভিড় হয় দেশের সব সমাধিভূমিতে। প্রাচীন জীবিতদের জন্য ফুল হাতে আসে ভবিষ্যতের মৃতরা। বাহারি রঙের চন্দ্রমল্লিকা ফুলে ফুলে সযত্নে সাজিয়ে দেয় সমাধির চারি ধার। জীবনের উত্তাপ নিয়ে প্রতিটি সমাধি উজ্জ্বল হয় ফুলের রঙে রঙে, সৌরভে। শোকের মাঝেও এক আনন্দাভাস, মৃত্যুর শীতলতায় খানিকটা উষ্ণতা, উজ্জ্বলতা। এ যেন ফুলের সৌরভে আত্মার অবগাহন। একদিন যারা ছিল হাসি-কান্না, মায়া মমতার, রূপ, রস সৌরভের অংশ তাঁরা আজ নেই, আজ তাঁরা মহাকালের রহস্যময় অজানা জগতের চির বাসিন্দা। প্রিয়জনেরা তাঁদের বাঁচিয়ে রেখেছে স্মৃতিতে, হৃদয়ে। জীবনের অপর প্রান্ত থেকে বছরের এ দিনটি শুধুই তাঁদের জন্য। ফ্রান্সের জাতীয় পরিসংখ্যান এবং অর্থনৈতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, ফ্রান্সে মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে ১,৭০০ জন। তাদের জন্য যে সমাধিভূমি সে এক বিশাল উদ্যান। ঝাউ, মেপল, একাশিয়া, বার্চ, হর্স-চেস্টনাট, বাদাম, আখরোট, লেবু, তিইয়ল কত রকমের গাছ আর ফুলের কেয়ারি সেখানে! লম্বা লেজ উঁচিয়ে ডেকে যায় বকতুরে পাখি বড় দোয়েল, পাখিদের আনন্দ আশ্রম যেন এই উদ্যান।
চন্দ্রমল্লিকা বা ক্রিস্যানথিমাম বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ফুল, গোলাপের পরেই এর স্থান। ক্রিস্যানথিমাম নামটি গ্রিক শব্দ ‘ক্রাইসোস’ (সোনার) এবং ‘অ্যান্থমন’ (ফুল) থেকে এসেছে। প্রকৃতিতে পাওয়া যায় চন্দ্রমল্লিকার প্রায় ৪০টি প্রজাতি। তবে শংকরায়ণ ঘটিয়ে মনোমুগ্ধকর হাজার হাজার জাতের উদ্ভাবন করা হয়েছে ইতিমধ্যেই। ফ্রান্সে চন্দ্রমল্লিকা শোকের প্রতীক হলেও জাপানে ‘জাতীয় ক্রিস্যানথিমাম দিবস’ বা ‘সুখের উৎসব’ হলো চন্দ্রমল্লিকার উৎসব। সেখানে প্রতি বছর ৯ সেপ্টেম্বর অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে এ উৎসব পালন করা হয়। জাপানিরা ৯ সংখ্যাটিকে শুভ সংখ্যা মনে করে। তাই বছরের নবম মাসের ৯ তারিখকে বেছে নিয়েছে এই সুখের উৎসবের জন্য। তার ওপর, জাপানের সম্রাট তাঁর রাজকীয় সিল মোহরে এই ফুলটির প্রতিকৃতি ব্যবহার করেন এবং সে দেশের পাসপোর্টের প্রচ্ছদে অঙ্কিত থাকে এ ফুলটি। আর ফুল প্রিয় জাপানিরা এ ফুলের নাম দিয়েছে ‘কিকু’। দেশ আর সংস্কৃতি ভেদে শোক আর উৎসবে একই ফুল এই চন্দ্রমল্লিকা।
ফ্রান্সের কথা হচ্ছিল, সাত কোটিরও কম জনসংখ্যার এ দেশটিতে শুধু অক্টোবর ও নভেম্বর এ দুই মাসে বিক্রি হয় ফুলসহ প্রায় ২ কোটি চন্দ্রমল্লিকার গাছ। প্রতিটি গাছের দাম গড়ে ৫ থেকে ১৫ ইউরো। বিক্রির জন্য বড় বড় সুপার শপগুলো তাদের বিস্তৃত পার্কিংয়ের অনেকখানি জুড়ে সাজিয়ে রাখে এই ফুলের পসরা—দেখলে মনে হয় রঙিন পুষ্প মেলা। ক্রেতারা শেষ মুহূর্তে ভিড় এড়াবার জন্য কয়েক দিন আগে থেকেই কিনে রাখেন পুরো টবসহ ঘন পুষ্পে আচ্ছাদিত গাছ। ফুলচাষিরা জানিয়েছেন, এ ফুলের আরেকটি গুণ হলো শীত উপেক্ষা করে অনেক দিন টিকে থাকতে পারে। তা ছাড়া পানির চাহিদাও কম। হতে পারে এ জন্যই ফরাসিরা অত্যন্ত মনোগ্রাহী ফুলটিকে বেছে নিয়েছে মহাকালে বিলীন হয়ে যাওয়া পরলোকগত প্রিয়জনদের ভালোবাসা জানবার জন্য। চলে যাওয়া ভালোবাসার দিকে এভাবে ফিরে তাকানো হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
লেখক : ফরাসি বিচার বিভাগে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত