রাশিয়ায় মস্কোর একটি স্কুলে ভূগোলের শিক্ষক কামরান মানাফ্লাই। ২৮ বছর বয়সী এই শিক্ষক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নিজের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। নিজের একান্ত মত জানিয়ে দেওয়া ওই পোস্টে রাশিয়ার সমালোচনা রয়েছে। কেবল এই কারণেই চাকরি হারাতে হয়েছে কামরানকে।
বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু কামরান নয়, রাশিয়ায় যুদ্ধবিরোধী কোনো কথা বললে বা কোনো মত ইউক্রেনের পক্ষে গেলেই চাকরি হারাতে হচ্ছে। সেন্ট্রাল মস্কোতে স্কুলে শিক্ষকদের এক বৈঠকে শিক্ষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়, ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে সরকারি অবস্থান থেকে কিছুতেই বিচ্যুত হওয়া যাবে না।
কামরান মানাফ্লাই বলেন, ‘আমি তো রাষ্ট্রের অপপ্রচার মেনে নিতে পারি না। এসব নিয়ে নিজস্ব মত জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে লিখেছিলাম।’ তিনি বলেন, এর দুই ঘণ্টা পরই স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাঁকে ফোন করে ওই পোস্ট ডিলিট করে দিতে বলেন। তা না হলে চাকরি ছাড়তে হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন।
কিন্তু নিজস্ব মতে অনড় কামরান পোস্ট ডিলিট করেননি। তিনি বলেন, ‘আমি জানি, এখানে যুক্তির কোনো দাম নেই। তাই আমি চিন্তা করেছি, চাকরি ছেড়ে দেওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।’
পরদিন পদত্যাগপত্র জমা দিতে স্কুলে গেলে কামরানকে ফটক দিয়ে স্কুলে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। বিষয়টি জানতে পেরে শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে বাইরে এসে কামরানকে সমর্থন করে ‘বিদায়’ জানিয়েছে। এ কারণে কামরান অনুমোদন ছাড়াই সমাবেশ করছে—এমন অভিযোগে কেউ কেউ পুলিশকেও জানিয়েছে। এক ভিডিও চিত্রেও এমনটি দেখা গেছে।
এর পরদিন কামরান স্কুলে গিয়ে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে এসেছেন। এ সময় প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। কেন ইনস্টাগ্রামে রাজনৈতিক মত প্রকাশ করেছিলেন প্রধান শিক্ষক কামরানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে তা জানতে চান। কিন্তু কামরান তা না জানিয়ে পদত্যাগ করতে চাইলে প্রধান শিক্ষক জানান, তাঁকে বহিষ্কার করা হবে।
কামরান বলেন, ‘এর দুদিন পর কর্মক্ষেত্রে অনৈতিক আচরণের কারণে আমাকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানতে পারি। এটা ব্যাপার না। কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশকে “অনৈতিক” বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ।’
রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর রাশিয়ার হাজারো নাগরিক বিশেষ করে মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গে এই ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’-এর বিরোধিতা করে, পিটিশনে স্বাক্ষর করে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পোস্ট করে এবং রাস্তায় যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভে যোগ দেয়। রাশিয়া সরকার এই বিক্ষোভ কঠোর হাতে দমন করেছে। হাজারো বিক্ষোভকারীকে আটক করেছে। নতুন আইন প্রণয়ন করেছে, যাতে রাশিয়ান সামরিক বাহিনী সম্পর্কে ‘ভুয়া’ তথ্য ছড়ালে ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
রাশিয়ার সংবাদপত্র নোভায়া গেজেটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কামরানের ওই ইনস্টাগ্রাম পোস্টটি এখনো নতুন আইন ভঙ্গ করেনি। কিন্তু তারপরও তাঁকে চাকরি হারাতে হয়েছে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত মস্কিনো সিনেমা চেইনের ব্যবস্থাপক কাতিয়া দোলিনিনা। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে তাঁর রাজনৈতিক মত কামরানের মতো হলেও তিনি তা প্রকাশ করতে রাজি নন। এমনকি আগে সরকারবিরোধী আন্দোলনেও যোগ দেননি তিনি। শুরুর দিকে এই তরুণী বলেছিলেন, ‘আমি আমার চাকরি পছন্দ করি। এই চাকরি আমি আনন্দ নিয়েই করি। তাই এই চাকরি আমি হারাতে পারব না।’
যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর কাতিয়ার মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে। তাঁর কাছে ইউক্রেনে রাশিয়ার তথাকথিত ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’-এর বিরুদ্ধে একটি খোলা চিঠি লেখেন এক বন্ধু। ওই চিঠিতে অনেকেই নিজের নাম সই করেছেন। চিঠিটি পড়ার পর আর দেরি না করে নিজের নাম লিখে সই করে দিয়েছেন কাতিয়া দোলিনিনা।
ভয় কাটিয়ে এবার কাতিয়া বলেন, ‘ওই মতের সঙ্গে আমি একমত। এই অভিযান শিগগিরই বন্ধ হওয়া উচিত। এটা একদম ঠিক হচ্ছে না।’
চিঠিতে সই করার পর কাতিয়াকে বস ফোন করে ওই চিঠি থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিতে বলেন। তা না হলে চাকরি ছাড়তে বলেন। যদি তা না হয়, তাহলে তাঁকে ছাঁটাই করা হবে বলে জানান ওই বস। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মস্কিনো সিনেমা কর্তৃপক্ষ কোনো জবাব দেয়নি।
এ ঘটনার পর কাতিয়া নিজে থেকেই পদত্যাগ করেছেন। কারণ, তিনি নিজে থেকে পদত্যাগ না করলে কর্তৃপক্ষ ছাঁটাই করার একটা বাজে অজুহাত খুঁজে বের করত। তা পরে অন্য কোনো চাকরিতে ঝামেলা সৃষ্টি করত।
মস্কোর একটি সরকারি মেডিকেল সেন্টারের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অ্যানা লেভাদনায়া একজন ইনস্টাগ্রাম তারকাও। সেখানে তাঁর ফলোয়ারের সংখ্যা ২০ লাখের বেশি। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শুরু হওয়ার সময় তিনি বিদেশে ছিলেন। সেখান থেকেই তিনি ইনস্টাগ্রামে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে পোস্ট দেন। ফলোয়ার বেশি থাকায় এই পোস্ট সহজেই ওই মেডিকেল কর্তৃপক্ষসহ সবার নজরে চলে যায়।
এর কয়েক দিন পর বিদেশে থেকেই অ্যানা সহকর্মীদের পাঠানো এক ভিডিওতে জানতে পারেন, মেডিকেলের পরিচালক এক সম্মেলনে শতাধিক সহকর্মীর সামনে তাঁর যুদ্ধবিরোধী মতামতের কঠোর নিন্দা করেছেন। এর কয়েক দিন পর তাঁকেও পদত্যাগ করতে বলা হয়, তা না হলে তাঁকে ছাঁটাই করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। পরে বাধ্য হয়ে অ্যানাকেও সরকারি ওই প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছাড়তে হয়েছে।