রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কতটা বদলে দিল বিশ্বকে
ইউক্রেনে হামলার ১০০ দিন পেরিয়েছে। এত দিনের যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এসেছে নানা পরিবর্তন। বৈশ্বিক অর্থনীতি ও পরিস্থিতি অনেকটা টালমাটাল হলেও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিজের অবস্থানে অনড়। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা চালায় রাশিয়া। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত কী বদলেছে আর কী বদলায়নি, এক বিশ্লেষণে তা তুলে ধরেছে এএফপি।
পুতিন একঘরে
ইউক্রেনে হামলা শুরুর আগে পুতিন পশ্চিমা দেশে যাতায়াত করতেন। ২০১৯ সালে গ্রীষ্মকালীন অবকাশে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর বাসভবনে অতিথি হিসেবেও গিয়েছিলেন তিনি। তবে এখন পশ্চিমাদের চোখে পুতিন ‘স্বৈরশাসক’। পশ্চিমারা পুতিনকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। পুতিন এখন পশ্চিমাদের কাছে অনেকটাই একঘরে। পুতিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ একসময় নিয়মিত পশ্চিমা দেশে সফর করলেও এখন তাঁর ওপরেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
ইউক্রেনে হামলা নিয়ে খোদ রাশিয়াতেও পুতিনের সমালোচনা রয়েছে। পুতিনের স্বাস্থ্যগত অবস্থা নিয়েও রয়েছে নানা গুঞ্জন। তবে পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রেখেছেন। এমনকি ইউক্রেনে হামলা নিয়ে পুতিনের পক্ষে সমর্থনও রয়েছে।
মানচিত্রে বদল
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে গিয়ে রাশিয়া যতটা ভেবেছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। কিয়েভ দখল করার প্রাথমিক লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে দেশটি। তবে রাশিয়ার সেনাবাহিনী ইউক্রেনের ভেতরের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান নিয়েছে। মস্কো ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দনবাস দখল করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
কৃষ্ণসাগরের এ উপদ্বীপ ২০১৪ সালে অধিগ্রহণ করে রাশিয়া। রাশিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দনবাসের লুহানস্ক ও দোনেৎস্ককে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেছে। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনোই দনবাসকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ইউক্রেন থেকে সেনা প্রত্যাহার নিয়ে পুতিনের কোনো তাড়াহুড়ো নেই। পুতিনের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী, তা নিয়ে এখনো অস্পষ্টতা রয়েছে।
ভূতাত্ত্বিক ও সাবেক কূটনীতিক মিশেল ফাউচার এএফপিকে বলেন, যদি দনবাসের পতন হয়, তাহলে পশ্চিম ইউক্রেনের কৌশলগত বন্দর ওডেশা ইউক্রেনের পরবর্তী হামলার লক্ষ্য হবে। তিনি আরও বলেন, এখন যে সময় যাচ্ছে, তা ইউক্রেন পরিস্থিতির অনুকূলে নেই।
রুশ জোট
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত দিক আলাদা হলেও রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগের ক্ষেত্রে তারা এককাট্টা। তবে চীন কখনোই রাশিয়ার হামলার নিন্দা জানায়নি। পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার পর মস্কো বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতেও চেয়েছে। সোভিয়েত যুগের সময়ও রাশিয়া ও চীনের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল।
ধারণা করা হচ্ছে, সে সময়েই ফিরতে চায় তারা। অস্ত্র বিক্রিতে রাশিয়ার অন্যতম মিত্রদেশ ভারতও এ বিষয়ে একই রকম সতর্ক। ন্যাটোর সদস্য ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান মস্কোর সঙ্গে জোট ভাঙার ব্যাপারে সতর্ক; যদিও ইউক্রেন যুদ্ধে তুরস্কের ড্রোন ব্যবহার করেছে তারা।
সাউথ আফ্রিকান ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের আফ্রিকান গভর্নেন্স অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি প্রোগ্রামের প্রধান স্টিভেন গ্রুজ বলেন, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জোট ব্রিকসের বেশির ভাগ দেশ এই হামলার নিন্দা জানানোর ব্যাপারে অনিচ্ছুক ছিল। তিনি আরও বলেন, আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ আছে, যারা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো নিরপেক্ষ থাকতে চায়। তবে এভাবে আসলে দেশগুলো রাশিয়াকে সমর্থনই জানায়।
ন্যাটোর আলাদা চেহারা
২৪ ফেব্রুয়ারির আগে নরডিক দেশগুলোর রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায় ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোর সদস্যভুক্ত হওয়ার অ্যাজেন্ডা গুরুত্ব পায়নি। তবে এখন রাশিয়ার সঙ্গে স্থলসীমান্ত থাকা দেশ ফিনল্যান্ড ও বাল্টিক সাগর নিয়ে রাশিয়ার দীর্ঘদিনের শত্রুদেশ সুইডেন ন্যাটোতে যোগ দিতে আবেদন করেছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্রদেশগুলো রাশিয়ার সীমান্তবর্তী ন্যাটো দেশগুলোর নিরাপত্তা রক্ষায় কয়েক হাজার সেনা পাঠিয়েছে। পোল্যান্ড ও বাল্টিক সাগরের দেশগুলোয় এসব সেনা পাঠানো হয়েছে।
ইউক্রেনে হামলার কারণ হিসেবে পুতিন সব সময়ই বলে এসেছেন ন্যাটো থেকে রাশিয়াকে সুরক্ষিত রাখার কথা। এর পাল্টা জবাব হিসেবেই এসব পদক্ষেপ নিচ্ছে ন্যাটো
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় বিশ্বের ওপর প্রভাব
পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপে একমত হয়েছে। পশ্চিমারা অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়াকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চায়। একই সঙ্গে পুতিনকে রাজনৈতিকভাবেও কোণঠাসা করতে চায়।
তবে এসব নিষেধাজ্ঞা ও বিধিনিষেধের কারণে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোও ঝুঁকিতে পড়ছে। রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম প্রধান শস্য সরবরাহকারী দেশ। ইউরোপীয় বেশির ভাগ দেশ রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার তেলের ওপর সীমিত পর্যায়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপে সম্মত হয়েছে। রাশিয়ার গ্যাসের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে সারা বিশ্বে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সরবরাহব্যবস্থা, খাদ্য ও জ্বালানি খাতে যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে। যুদ্ধের কারণে খাদ্যসংকটের আশঙ্কা বেড়েছে। বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো রাশিয়ার আমদানির ওপর নির্ভরশীল।
স্টিভেন গ্রুজ বলেন, এ যুদ্ধের সুনির্দিষ্ট প্রভাব কী পড়তে পারে, তা কে জানে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রতিবাদে বিক্ষোভ হতে পারে।