যে কারণে যুক্তরাজ্যও ছেড়েছিলেন হ্যারি-মেগান
ব্রিটিশ রাজপরিবার ছেড়ে যাওয়া হ্যারি-মেগান দম্পতির ‘বোমা ফাটানো’ সাক্ষাৎকারে তোলপাড় চারদিক। সংকটে পড়েছে খোদ রাজপরিবারও। এর মধ্যেই দীর্ঘ ওই সাক্ষাৎকারের অপ্রকাশিত আরও কিছু কিছু অংশ প্রকাশ্যে এসেছে। এ থেকে জানা যাচ্ছে, অজানা আরও অনেক তথ্য। প্রিন্স হ্যারি বলেছেন সেই কথা, যে জন্য রাজপরিবার ছাড়ার পর যুক্তরাজ্যও ছাড়তে হয়েছে তাঁকে।
৭ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএস টিভিতে ‘অপরাহ উইথ মেগান অ্যান্ড হ্যারি: এ সিবিএস প্রাইমটাইম স্পেশাল’ শিরোনামের বিশেষ সাক্ষাৎকারটি প্রচার করা হয়। জনপ্রিয় মার্কিন উপস্থাপক অপরাহ উইনফ্রেকে দেওয়া ৩ ঘণ্টা ২০ মিনিটের ওই বিশেষ সাক্ষাৎকারের কিছু ফুটেজ পরে প্রকাশ করেছে মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিবিএস। সেখানে অপরাহ উইনফ্রেকে যুক্তরাজ্যের ডিউক অফ সাসেক্স প্রিন্স হ্যারি জানিয়েছেন, রাজপরিবার ছাড়ার পরে কেন যুক্তরাজ্যও ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। জানিয়েছেন রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁর বাড়তে থাকা দূরত্বের কথাও।
বিবিসির আজ মঙ্গলবারের খবরে জানা যায়, প্রিন্স হ্যারি বলেছেন, তাঁর ও স্ত্রী মেগান মার্কেলের যুক্তরাজ্য ছাড়ার পেছনে ট্যাবলয়েড পত্রিকার বর্ণবাদী আচরণ বড় ভূমিকা রেখেছিল। হ্যারির কথায়, ‘যুক্তরাজ্যের ট্যাবলয়েড গণমাধ্যম সংকীর্ণতাবাদী। ট্যাবলয়েড গণমাধ্যমগুলো ভয় এবং নিয়ন্ত্রণের বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি করেছিল।’
হ্যারির এ ধরনের অভিযোগের প্রতিবাদ জানিয়েছে দ্য সোসাইটি অব এডিটরস। তারা বলেছে, সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়াই হ্যারি এ ধরনের অভিযোগ করেছেন। ব্রিটিশ গণমাধ্যম সংকীর্ণবাদী নয়। এএফপির খবরে জানা যায়, প্রতিবাদ জানিয়েছে ডেইলি মেইলও।
এদিকে বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে জানা যায়, সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর বাকিংহাম প্রাসাদের ভাবমূর্তি নিয়ে সংকটজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাকিংহাম প্রাসাদ এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে।
কারও সমর্থন না পেয়ে সরে দাঁড়ানোর জন্য রাজপরিবারের কেউ দুঃখ প্রকাশ করেননি। ব্যাপারটা এমন যে রাজপরিবার ছাড়ার সিদ্ধান্তটা আমাদের। এ কারণে আমাদের এমন পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে।প্রিন্স হ্যারি
অপরাহ উইনফ্রে স্থানীয় সময় গতকাল সোমবার সিবিএসকে জানিয়েছেন, প্রিন্স হ্যারি পরে তাঁকে জানিয়েছেন, সন্তানের গায়ের রং নিয়ে রানি এলিজাবেথ অথবা প্রিন্স ফিলিপ কোনো মন্তব্য করেননি। এই মন্তব্য রাজপরিবারের কে করেছিলেন, তা জানাননি প্রিন্স হ্যারি। তবে এটা নিশ্চিত করেছেন যে অর্চির দাদা-দাদির মধ্যে কেউ এ ধরনের মন্তব্য করেননি।
সাক্ষাৎকারে হ্যারির সঙ্গে একমত পোষণ করে মেগান বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গণমাধ্যমের সঙ্গে হঠকারী সম্পর্ক স্থাপন করেছে। তাঁকে (মেগান) ও হ্যারিকে গণমাধ্যমের অসত্য প্রচার থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন রাজপরিবারের গণমাধ্যম ব্যবস্থাপকেরা।
হ্যারি বলেন, তাঁর ভাই ও বাবা রাজপরিবারের নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে গেছেন। গত বছরের শুরু থেকে তাঁর পরিবার তাঁকে (হ্যারি) কোনো আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে না। তাঁরা বাবা তাঁর ফোন ধরা বন্ধ করে দিয়েছেন। হ্যারি বলেন, তিনি ভাইকে ভালোবাসেন। ভাই ও বাবার সঙ্গে আবার সম্পর্ক উন্নত করতে চান। মেগান বলেন, গত মাসে প্রিন্স ফিলিপ হাসপাতালে যখন চিকিৎসাধীন ছিলেন, তখন তিনি রানি এলিজাবেথকে ফোন করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রেস সচিব জেন সাকি বলেছেন, ব্যক্তিগত জীবন ও মানসিক কষ্টের কথা জনসমক্ষে বলে হ্যারি ও মেগান সাহসের পরিচয় দিয়েছেন।
অপরাহ উইনফ্রেকে দেওয়া বিশেষ ওই সাক্ষাৎকারে ডাচেস অব সাসেক্স মেগান মার্কেল জানান, ব্রিটিশ রাজপরিবারের জৌলুশপূর্ণ জীবনে থেকেও তিনি ভালো ছিলেন না। তিনি বলেছেন, পরিবারের মধ্য থেকেও তিনি এত বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছিলেন যে একটা সময় বেঁচে থাকার ইচ্ছাই হারিয়ে ফেলেন। ভাবছিলেন আত্মহত্যা করবেন। রাজপরিবারে মেগানের মানসিক কষ্ট ও তাঁর ছেলে অর্চির জন্মের আগে গায়ের রং নিয়ে বৈষম্যমূলক আলোচনার কথাও বলেন মেগান।
এসব ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তিনি বলেন, তিনি সব সময় রানি এলিজাবেথের ভক্ত। রাজপরিবার বর্ণবাদী বলে বিশ্বাস করেন কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে বরিস জনসন বলেন, রাজপরিবার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীদের কোনো মন্তব্য না করাই উচিত।
অপরাহ উইনফ্রেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হ্যারি বলেন, রাজপরিবারের দায়িত্ব ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার কিছু সময় পরেই দ্য সোসাইটি অব এডিটরসের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব রয়েছে, এমন এক ব্যক্তি গণমাধ্যমের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থানে না যেতে তাঁকে সতর্ক করেছিলেন। ওই ব্যক্তি হ্যারিকে বলেছিলেন,‘ গণমাধ্যমের সঙ্গে এমন করবেন না। তারা আপনার জীবন ধ্বংস করে দেবে।’
২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে এক আলোচনায় দ্য সোসাইটি অব এডিটরসের ওই বন্ধু হ্যারিকে বলেছিলেন, আপনাকে বুঝতে হবে যুক্তরাজ্য খুবই সংকীর্ণতাবাদী মনোভাব পোষণ করে। জবাবে হ্যারি বলেন, যুক্তরাজ্য সংকীর্ণতাবাদী নয়। ব্রিটিশ গণমাধ্যম সংকীর্ণতাবাদী। বিশেষ করে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড।
অপরাহ উইনফ্রেকে হ্যারি বলেন, ‘কারও সমর্থন না পেয়ে সরে দাঁড়ানোর জন্য রাজপরিবারের কেউ দুঃখ প্রকাশ করেননি। ব্যাপারটা এমন যে রাজপরিবার ছাড়ার সিদ্ধান্তটা আমাদের। এ কারণে আমাদের এমন পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে।’
প্রিন্স হ্যারি বলেন, তিনি রাজপরিবারের নিয়মের বেড়াজাল থেকে সরে আসতে পেরেছেন। কিন্তু তাঁর ভাই প্রিন্স উইলিয়াম তা পারেননি। প্রিন্স উইলিয়াম রাজপরিবার থেকে সরে দাঁড়াতে চান কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে হ্যারি বলেন, তিনি তা জানেন না।
ডিউক অব সাসেক্স বলেন, তিনি সব সময় প্রাসাদে তাঁর ভাই ও পরিবারের বাকি সদস্যদের পাশে থাকতে চাইবেন। রাজপরিবারে যা ঘটছে, তা-ই তিনি তাঁদের বোঝাতে চান। হ্যারি আরও বলেন, তাঁর বাবা নানা কারণে গণমাধ্যমের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চান।
তবে দ্য সোসাইটি অব এডিটরস সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ ছাড়া গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ তোলায় হ্যারি-মেগানের সমালোচনা করেছে। নির্বাহী পরিচালক ইয়ান মুরে বলেন, ব্রিটিশ গণমাধ্যম সব সময়ই ক্ষমতাধর, প্রভাবশালী ও তারকাদের আলোচনায় রেখেছে। কখনো হয়তো তাঁদের কাছে করা প্রশ্ন বিব্রতকর হতে পারে। তবে ব্রিটিশ গণমাধ্যম কখনোই বর্ণবাদী নয়।
ব্রিটিশ সম্প্রচারমাধ্যম সিবিসি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপ্রকাশিত একটি ফুটেজ শেয়ার করেছে। তাতে দেখা গেছে প্রিন্স হ্যারি বলেছেন, গত বছরের জানুয়ারি মাসে সানদ্রিংহামে রানির ব্যক্তিগত বাড়িতে তাঁর (হ্যারি) ও মেগানের আমন্ত্রণ ছিল। তবে হঠাৎ করেই সেটি বাতিল করা হয়। রানির ব্যক্তিগত কর্মকর্তা বলেন, রানি পুরো সপ্তাহে ব্যস্ত থাকবেন।
এসব ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তিনি বলেন, তিনি সব সময় রানি এলিজাবেথের ভক্ত। রাজপরিবার বর্ণবাদী বলে বিশ্বাস করেন কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে বরিস জনসন বলেন, রাজপরিবার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীদের কোনো মন্তব্য না করাই উচিত।
হ্যারি বলেন, ‘যখন আপনি কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান হবেন, তখন পরামর্শ দেওয়ার জন্য আপনার চারপাশে অনেকে থাকবেন। আমার দুঃখ হয় এসব পরামর্শের বেশির ভাগই বাজে হয়।’
অপ্রচারিত ওই ফুটেজে ডাচেস অব সাসেক্স বলেন, রাজপরিবারের অন্য সদস্যদের তুলনায় তাঁকে গণমাধ্যমে খারাপভাবে উপস্থাপন করা হতো। যদিও প্রিন্স উইলিয়ামের সঙ্গে বিয়ের আগে ডাচেস অব কেমব্রিজকে ‘ওয়েটি কেটি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা তাঁর (মেগান) সঙ্গে করা আচরণের মতো ছিল না। মেগান বলেন, ‘পরিবারের কোনো সদস্য যদি সাবলীলভাবে বলতেন, রূঢ় সব আচরণের সঙ্গে আমাদের মানিয়ে চলতে হবে, কিন্তু রূঢ় আর বর্ণবাদ এক জিনিস নয়।’
মেগান বলেন, আমার চারপাশের যেকোনো কিছু নিয়ে গণমাধ্যমের এক ধরনের বিশেষ আগ্রহ কাজ করত। এমনকি আমার মা-বাবার গতিবিধির খবর নেওয়ার জন্যও গণমাধ্যমকে অর্থ দেওয়া হয়েছিল।