মলদোভা কি অস্তিত্ব টেকাতে পারবে

রাশিয়ার হামলার মুখে ইউক্রেন ছেড়ে মলদোভার শরণার্থীশিবিরে পৌঁছেছেন হাজারো মানুষ।
ছবি: এএফপি

রোমানিয়ার বাসের জন্য অপেক্ষা করার সময় কাঁপছিলেন এলিজা। ইউক্রেন থেকে সাত কিলোমিটার হেঁটে মাত্র মলদোভায় এসে পৌঁছেছেন। যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে চান তিনি। ইউক্রেন থেকে মলদোভায় আসা শত শত লোক এলিজার মতো একই পথ বেছে নিচ্ছেন। এলিজা বলেন, ‘আমি এখানে থাকতে পারছি না। পুতিন এ দেশটাও ধ্বংস করে দেবেন।’

ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন কারও সদস্য নয় ছোট্ট এ দেশটি। রাশিয়ার ইউক্রেনে হামলার পর থেকেই বেশ উদ্বেগে রয়েছে দেশটির প্রশাসন। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর থেকে মলদোভায় ২ লাখ ৬০ হাজার ইউক্রেনীয় নাগরিক ঢুকে পড়েছেন। এর মধ্যে এখনো এক লাখ এক হাজার মানুষ সেখানে অবস্থান করছেন। সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্র মলদোভার জনসংখ্যা ২৬ লাখের কিছু বেশি। ইউরোপের অন্যতম দরিদ্র দেশ এটি। ইউক্রেনের প্রতিবেশীদের মধ্যে দ্রুততম শরণার্থীর আগমন ঘটেছে এখানেই।

দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকু পপেস্কু বলেন, ‘আমরা ধারণক্ষমতার (ব্রেকিং পয়েন্টের) কাছাকাছি চলে এসেছি।’

ব্রিটিশ গণমাধ্যম ইকোনমিস্ট বলছে, মলদোভার এখনই জরুরি সাহায্য প্রয়োজন। যদি সাহায্য না পাওয়া যায়, তবে সেখানে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। রাশিয়ার হামলা শুরুর আগে মলদোভার সরকার বলেছিল, তাদের সর্বোচ্চ ১৫ হাজার পর্যন্ত শরণার্থী নেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। ইতিমধ্যে সেখানকার শরণার্থীশিবিরগুলো ভরে গেছে। চাপ বেড়েছে সীমান্তরক্ষীদের ওপর। ত্রাণ সরবরাহ বিপজ্জনকভাবে ঘাটতির দিকে চলে গেছে।

মলদোভার সরকার ইতিমধ্যে বিশাল ঘাটতির মধ্যে পড়ে গেছে। সেখানে গ্যাস আমদানি করা হয় রাশিয়া থেকে। গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে রয়েছে দেশটি।

মলদোভার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পপেস্কু বলেন, তাঁদের সীমান্তঘেঁষা ইউক্রেনের ওডেসা শহরে যদি হামলা হয়, তবে আরও লাখো শরণার্থী এখানে আসবেন। এতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। প্রায় ১০ লাখ মানুষের শহর ওডেসা মলদোভা থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে। সেখানে রুশ সেনাদের সম্ভাব্য হামলা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে সবার মধ্যে।

পপেস্কু বলেন, ‘আমরা পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য একটি বড় হুমকির কথা বলছি।’
মলদোভা সরকার ইতিমধ্যে তাদের সীমান্তরক্ষীদের সাহায্য করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাহায্য চেয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্ত সংস্থা ফ্রনটেক্সকে মলদোভার সীমান্ত পুলিশকে সহায়তার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। তবে মলদোভার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আর্থিক সহায়তা। দেশটিতে জরুরি সাহায্য হিসেবে ইউরোপের পক্ষ থেকে মাত্র ১ কোটি ৬৫ লাখ মার্কিন ডলার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

কিন্তু মলদোভার সরকার ইতিমধ্যে বিশাল ঘাটতির মধ্যে পড়ে গেছে। সেখানে গ্যাস আমদানি করা হয় রাশিয়া থেকে। গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে রয়েছে দেশটি। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে দেশটি দুটি বড় ধরনের মন্দার মধ্য দিয়ে গেছে। এর মধ্যে করোনা মহামারির কারণে বড় ধাক্কাও ছিল। এখন বড় ধরনের সহায়তা না পেলে মলদোভা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে না। মলদোভাবাসীর অভিযোগ, ইউরোপ তাদের ভুলে গেছে। যত প্রশংসা, স্তুতি ও সাহায্য পাচ্ছে ইউক্রেনের প্রতিবেশী ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধনী দেশগুলো।

মলদোভার সংকট শুধু শরণার্থী নিয়েই নয়। তাদের ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে রাশিয়া–ভীতি। দেশটির সরকার মনে করছে, রাশিয়া যদি ইউক্রেনে সফল হয়, তবে মলদোভাকে ছেড়ে কথা বলবে না। কারণ, ইউক্রেনের মতোই মলদোভাতেও রুশ ভাষাভাষী বিশাল সংখ্যালঘু লোকজন রয়েছে। সেখানকার রাজনীতিও ইউরোপপন্থী ও রুশপন্থী দুটি ধারায় বিভক্ত।

কিয়েভের উত্তরে ইরপিন শহরে গুলির চিহ্ন রয়েছে গাড়িতে। মলদোভার উদ্বেগ, সে দেশেও হামলা হতে পারে।
ছবি: এএফপি

মলদোভার ফরেন পলিসি অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা ভিক্টোরিয়া রোসা বলেন, মলদোভাকে অস্থিতিশীল করার জন্য রাশিয়ান প্রচেষ্টার সম্ভাবনা বেশি। পশ্চিমা গোয়েন্দা তথ্য বলছে, মলদোভার ওপর আক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি।

মলদোভার এক বিদেশি কূটনীতিক বলেন, ‘মলদোভাতে রাশিয়ার যে ধরনের প্রভাব আছে, তার পরিপূর্ণ ব্যবহার করে রুশপন্থী সরকার নিশ্চিত করতে চেষ্টা করবে। তারা সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করবে।’

মলদোভায় পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টার জন্য প্রাথমিক কর্মযজ্ঞ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ইউরোপিয়ান পলিসিস অ্যান্ড রিফর্মসের কর্মকর্তা লুলিয়ান গ্রোজা বলেন, মলদোভাবাসীর কাছে ভয়ভীতি দেখিয়ে নানা বার্তা পাঠানো শুরু হয়ে গেছে। তাতে বলা হচ্ছে, মলদোভা সেনা সংগ্রহ করছে। তরুণদের দেশ ত্যাগ করতে দেওয়া হবে না।

এ ছাড়া উদ্বেগ রয়েছে মলদোভা সীমান্তে রুশ সেনারা অগ্রসর হলে সেখানে থাকা তাদের প্রক্সি সমর্থকেরা তাদের সমর্থন দেবে। এসব উদ্বেগ মাথায় রেখেই দ্রুত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে চাইছে দেশটি। ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নপন্থী প্রেসিডেন্ট মাইয়া সান্ডু ৩ মার্চ ইইউর সদস্য হওয়ার আবেদনে সই করেছেন। তবে মলদোভাকে শিগগিরই ইইউর সদস্য করা হবে, এমন কোনো বিভ্রমের মধ্যেও নেই তারা। তবে এ–বিষয়ক প্রতিশ্রুতি তারা আশা করছে।

ইউক্রেন সেনারা কেবল তাদের দেশের জন্যই লড়ছে না, তারা মলদোভার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতেও লড়ছে।
লুলিয়ান গ্রোজা, কর্মকর্তা, ইনস্টিটিউট ফর ইউরোপিয়ান পলিসিস অ্যান্ড রিফর্মস

তবে এ আবেদনের কারণে মলদোভা সীমান্তের রুশ সমর্থিত ট্রান্সনিস্টরিয়া নামের ছোট্ট একটি অঞ্চল স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। সেখানে রুশ সেনা রয়েছে। ওডেসা আক্রমণের জন্য এখান থেকে সেনা পাঠানো হতে পারে। ইউক্রেন সেনারা বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে এ পথে থাকা সেতুগুলো ভেঙে ফেলেছে। দীর্ঘ মেয়াদে রাশিয়া পুরো দক্ষিণ ইউক্রেন দখল করে নিতে পারে এবং ট্রান্সনিস্টরিয়া রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করতে পারে।

ওডেসা দখল করা সম্ভব হলে ট্রান্সনিস্টরিয়াকে রাশিয়ার পক্ষ থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হতে পারে বা সেখানে রুশ সেনা আরও বাড়ানো হতে পারে। মলদোভার রাজধানী কিসিনাউয়ে আরেকটি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলেছে। গত নভেম্বরে রাশিয়ার পক্ষ থেকে একটি সমঝোতা প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর বিষয়বস্তু অবশ্য গোপন রাখা হয়। ওই প্রস্তাবে মলদোভাকে প্রাকৃতিক গ্যাসের দামে ব্যাপক ছাড়ের কথা বলা হয়। কিন্তু ওই প্রস্তাব মলদোভা সরকার প্রত্যাখ্যান করে।

ট্রান্সনিস্টরিয়া আরও আক্ষরিক অর্থে একটি টিন্ডারবক্সে পরিণত হতে পারে। এর উত্তরে কোবাসনা নামের একটি গ্রামে পূর্ব ইউরোপের বৃহত্তম গোলাবারুদ মজুত রয়েছে। এখানে সোভিয়েত যুগের ২০ হাজার টন গোলাবারুদ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ২০০৫ সালে মলদোভান একাডেমি অব সায়েন্সের ধারণা অনুযায়ী, কোবাসনায় কোনো বিস্ফোরণ হলে তা ১৯৪৫ সালে হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের সমান হবে।

লুলিয়ান গ্রোজা বলেন, প্রকৃতপক্ষে মলদোভায় যা ঘটতে চলেছে, তা আর তাঁদের হাতে নেই। দেশটির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ইউক্রেনের সেনারা রুশ সেনাদের রুখতে পারবে কি না, তার ওপর। ইউক্রেন সেনারা কেবল তাদের দেশের জন্যই লড়ছে না, তারা মলদোভার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতেও লড়ছে।


ইকোনমিস্ট ও এএফপি অবলম্বনে মো. মিন্টু হোসেন

আরও পড়ুন