‘মনে হচ্ছিল মৃত্যুতেই সব শেষ হবে’

রুশ বাহিনীর হামলায় ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইউক্রেনের মারিউপোল শহরের বেশির ভাগ ভবন। ক্ষতিগ্রস্ত একগুচ্ছ ভবনের সামনের রাস্তায় সার বেঁধে থাকা এসব গাড়ি অপেক্ষায় আছে আটকেপড়া বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়ার জন্য।
ছবি: রয়টার্স

দিন-রাত অবিরাম বোমাবর্ষণ। সের্গেই ভাগানোভ ভেবেছিলেন এ থেকে বাঁচার আর পথ নেই। মৃত্যুতেই সবকিছু শেষ হবে। ৬৩ বছর বয়সী এই চিত্রগ্রাহক ও তাঁর স্ত্রী ৬২ বছর বয়সী ইরিনার গত কয়েকটা দিন ইউক্রেনের বন্দরনগরী মারিউপোলের কেন্দ্রস্থলে একটি এক কক্ষের অ্যাপার্টমেন্টে কেটেছে।

বর্তমানে এই দম্পতি মারিউপোল থেকে পালিয়ে অন্য আরেক শহরে ঠাঁই নিয়েছেন। ভাগানোভ আল-জাজিরাকে দেওয়া এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি চিন্তা করছিলাম, প্রথমে আমাদের কোনটা ফুরাবে? খাবার? পানি? নাকি এর আগেই আমাদের ওপর বোমা পড়বে? একটা সময় আমি মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম।’

ইউক্রেনের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলে ৪ লাখ ৩০ হাজার মানুষের শহর মারিউপোল দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ঘিরে রাখে রুশ বাহিনী। দিন–রাত রাশিয়ার বিমান থেকে বোমা হামলা, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও কামান থেকে গোলা ছোড়ে তারা। এরই মধ্যে শহরটির বেশির ভাগ আবাসিক ভবন হয় ধ্বংস অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ভাগানোভ বলেন, হামলা থেকে বাঁচতে স্যাঁতসেঁতে ও অন্ধকার বেসমেন্টে যাওয়ার কোনো মানেই ছিল না। কারণ, এত ঘন ঘন হামলা হচ্ছিল যে তাহলে পুরো সময় তাঁদের সেখানেই থাকতে হতো।

হামলার প্রথম কয়েক দিন ভাগানোভ দম্পতি ঘরের দরজা–জানালা থেকে দূরে থাকার চেষ্টার করেন, যেন কাচের টুকরার আঘাতে তাঁদের মৃত্যু না হয়। এরপর প্রচণ্ড হামলার তোড়ে যখন জানালার কাচ ভেঙে যায়, তখন তাঁরা বিছানায় আশ্রয় নেন। ভাগানোভ বলেন, ‘বিছানায় আমরা আমাদের ওপর এক এক করে তিনটি কম্বল দিয়েছি। এরপর মৃত্যুর অপেক্ষা করেছি।’

স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এই কয় দিনে আমরা বুঝে গিয়েছিলাম রাশিয়ান বোমারু উড়োজাহাজের শব্দ কেমন এবং কোনটি থেকে কতগুলো বোমা ফেলত পারে। যেমন একটি উড়োজাহাজ উড়ে গেল, আমরা জানতাম এটি চারটি বোমা ফেলবে। চারটা বোমা ফেলা হয়ে গেলে আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতাম।’
‘তারা এ শহর ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল’

মারিউপোলই প্রথম শহর নয়, যেখান থেকে যুদ্ধের কারণে সরে আসতে হলো ভাগানোভকে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত রুশপন্থী বিদ্রোহী অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চলীয় শহর দোনেৎস্কে ছিলেন তিনি। সেখানে অর্থোপেডিক চিকিৎসক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। এরপর তিনি ফটোসাংবাদিকতায় আসেন। জিতেছেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার।

২০১৪ সালের রুশপন্থী বিদ্রোহীরা দোনেৎস্ক দখল করে নিলে তিনি শহর ছেড়ে মারিউপোলে চলে আসেন। দোনেৎস্ক থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে আজভ সাগর তীরবর্তী বন্দরনগরী মারিউপোলে এসে তিনি নিজের জন্য একটি ভবনের চারতলায় অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া পুরোদমে ইউক্রেনে হামলা শুরু করার কয়েক সপ্তাহ আগে ভাগানোভ ইউক্রেনীয় স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে গঠিত ‘আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা’ ইউনিটের জন্য প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি রাইফেল জোড়া দেওয়া ও খুলে ফেলার পদ্ধতি শিখেছিলেন। কিন্তু কোনো প্রশিক্ষণ বা যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতাই তাঁকে বিমান হামলা ও গোলাগুলির সেই ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে কীভাবে বেঁচে থাকা যায় তা শেখায়নি।

ষাটোর্ধ্ব এই ফটোসাংবাদিক বলেন, যখন একটি শহর বোমা ও রকেট হামলায় বিধ্বস্ত হয়, তখন সবই অর্থহীন।

কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক আলেক্সি কুশ আল–জাজিরাকে বলেছেন, রাশিয়া বুঝতে পেরেছিল যে মারিউপোলের দখল নিতে গেলে প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে। এ শহর নিয়ন্ত্রণ করা তাদের জন্য কঠিন হতো। তাই তারা এটিকে ধ্বংস করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মারিউপোলে রাশিয়ার হামলায় ২ হাজার ৩০০–এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। শহরটি বিদ্যুৎ, পানি ও কেন্দ্রীয় উত্তাপব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এমনকি খাদ্য ও ওষুধের সরবরাহ দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। এখানকার বাসিন্দাদের পানির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। এমনকি সামান্য রান্না ও পানি ফোটানোর জন্য অনেকে গাছ কেটে আবার অনেকে আসবাব পুড়িয়েছে।

ভাগানোভ সৌভাগ্যবান যে তাঁর ঘরে আলু, ভুট্টাসহ কিছু খাবার ও শূকরের চর্বি মজুত করা ছিল। তাঁর স্ত্রী ইরিনা লবণ দিয়ে মাংস সেদ্ধ করে কাচের জারে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। ঘরে মধু ছিল, প্রতিবেশীরা কিছু গাজর দিয়েছে। সেগুলো দিয়ে এই কয়েক দিন চলেছে।

ভাগানোভ বলেন, সৌভাগ্যবশত তাঁদের অ্যাপার্টমেন্ট ভবন অক্ষত ছিল, যদিও বোমা বিস্ফোরণে মনে হয়েছে, এটি যেন ‘প্লাস্টিসিনের তৈরি’। আর পাশের নয়তলা ভবনটি ‘মোমবাতির মতো জ্বলছিল’।

এই ফটোসাংবাদিক জানান, তাঁদের ভবনের বাসিন্দার সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। কারণ, আশাপাশে যাদের অ্যাপার্টমেন্ট ধ্বংস হয়ে গেছে, তাঁরা বাইরের ধ্বংসস্তূপ ও বরফে ঢাকা লাশের ওপর দিয়ে হেঁটে এই ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

একদিনের কথা স্মরণ করে ভাগানোভ বলেন, ‘আমাদের ভবনের বাইরে একজন ব্যক্তির লাশ পড়ে ছিল। সেই লাশ দেখে আমি অনেকক্ষণ ধরে ভাবছিলাম যদি কিছু হয়ে যায় আমি আমার স্ত্রীর লাশ কী করব? সেও (স্ত্রী) আমাকে বলল সে-ও একই কথা ভাবছে।’

শহরটিতে রাশিয়ার হামলা শুরু হওয়ার পর গত সোমবার প্রথমবারের মতো সেখান থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়। চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে ভাগানোভ ও তাঁর স্ত্রী এক বন্ধুর গাড়িতে করে মারিউপোল ছেড়ে পালাতে সক্ষম হয়।

এখন স্লোভাকিয়ার সীমান্তবর্তী পশ্চিম ইউক্রেনীয় শহর উজগোরোডে আছেন তাঁরা। এ যুদ্ধ–পরিস্থিতিতে ভাগানোভের ১০ কেজি ওজন কমেছে। এমনকি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অ্যাজমার চিকিৎসা নিতে হয়েছে। জীবনের এ চরম বাস্তবতা তাদের শিক্ষা দিয়েছে, প্রত্যাশা খুব কম রাখতে হবে। ভাগানোভ বলেন, ‘আমরা বেঁচে আছি। এক দিন এক দিন করে বেঁচে থাকব।’