ইরানের ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে বিশ্ব শক্তিগুলো ভিয়েনায় ব্যক্তিগত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আলোচনায় তেমন কোনো ফল দেখা যাচ্ছে না। জনসাধারণের দৃষ্টিতে ইরান ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য বেড়েই চলেছে। খবর কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল–জাজিরার।
মঙ্গলবার ইরানের প্রধান আলোচক এক টুইটে অভিযোগ করে বলেছেন, প্রতিপক্ষ এখনো বাস্তব কূটনীতির পরিবর্তে তাদের দোষারোপ খেলার অভ্যাস বজায় রেখেছে।
আলী বাঘেরি কানি আরও বলেছেন, কূটনীতির দ্বিমুখী রাস্তায় চলছে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ইউরোপের তিনটি দেশ ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্য। তাদের সঙ্গে রয়েছে ২০১৮ সালে চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্র। এই দেশগুলোর সমঝোতায় পৌঁছানোর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে।
এর আগে ইউরোপের তিনটি দেশের কূটনৈতিকেরা অভিযোগ করেন, ইরানের সঙ্গে এখনো বাস্তব আলোচনায় নামতে পারেননি তাঁরা। ইরান আলোচনার নামে শুধুই সময় নষ্ট করছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন সতর্ক করে বলেছেন, কূটনীতিই সর্বোত্তম বিকল্প ছিল। কূটনীতি ব্যর্থ হলে মিত্র ও অংশীদারদের সঙ্গে বিকল্প পন্থা নিয়ে কাজ করবে যুক্তরাষ্ট্র।
২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদেশগুলো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এই চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। দীর্ঘ আলোচনার পর এই চুক্তিতে পৌঁছায় সব পক্ষ।
ইরানের সঙ্গে হওয়া এই পরমাণু চুক্তির আনুষ্ঠানিক নাম জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ)। চুক্তি মোতাবেক ইরান পরমাণু কর্মসূচি সীমিত করতে সম্মত হয়েছিল। তেজস্ক্রিয় পদার্থ ইউরেনিয়ামের মজুত কমিয়ে আনতে রাজি হয় দেশটি। এই ইউরেনিয়াম পরমাণু অস্ত্র তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ছাড়া ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার জন্য ব্যবহৃত সেন্ট্রিফিউজের সংখ্যা কমিয়ে আনার শর্তও ছিল চুক্তিতে। এসব শর্ত মেনে চলার বদলে ইরানের ওপর আরোপ করা বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। বিশেষ করে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। তবে ২০১৮ সালে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ভিয়েনায় নতুন করে ওই চুক্তিতে ফেরা নিয়ে আলোচনার বিষয়ে ইউরোপের তিনটি দেশের আলোচকেরা সতর্ক করে বলেছেন, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির দ্রুত অগ্রগতির আলোকে আলোচনায় দ্রুত অগ্রগতি না হলে জেসিপিওএ শিগগিরই একটি খালি কলস হয়ে উঠবে।
যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এক বছর অপেক্ষা করে ইরান। এরপর ধীরে ধীরে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি বাড়িয়েছে এবং এখন ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি উন্নত সেন্ট্রিফিউজ ব্যবহার করছে। তবে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) নিশ্চিত করেছে যে দেশটি পারমাণবিক বোমার জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশ বিশুদ্ধতার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেনি। ইরানও ক্রমাগত বলে আসছে যে তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে হাঁটবে না।
সপ্তাহব্যাপী বিরতির পর বৃহস্পতিবার অস্ট্রিয়ার রাজধানীতে জেসিপিওএ পুনরুদ্ধারের সপ্তম দফা আলোচনা শুরু হয়েছে। বিরতির আগে, ইরান তার প্রস্তাবসংবলিত দুটি নথি উপস্থাপন করেছিল। তবে তা চুক্তির শর্তাবলির সঙ্গে যায় না বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল ইউরোপের তিন দেশ। ইরান বলেছে, তারা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার যাচাইয়ের জন্য তাদের দাবির বিষয়ে একটি তৃতীয় নথিও প্রস্তুত করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র জেসিপিওএ প্রত্যাহার করবে না, এমন নিশ্চয়তা চেয়েছে।
প্রধান আলোচক ও বিশেষজ্ঞ ওয়ার্ক গ্রুপের পর্যায়ে ভিয়েনায় অনেক দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেসিপিওএ যৌথ কমিশনের আরেকটি বৈঠক সপ্তাহান্তের আগে অনুষ্ঠিত হতে পারে।
টুইট বার্তায় গত সোমবার রাশিয়ার প্রধান আলোচক মিখাইল উলিয়ানভ বলেছেন, এখনো অসংখ্য সমস্যা রয়ে গেছে। তবে সব পক্ষই ফাঁকফোকরগুলো পূরণ করতে কাজ করছে।
সোমবার রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে ফোনালাপ করেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান। ফোনালাপে তিনি আলোচনায় আরও উদ্যোগের প্রস্তাব করার জন্য আলোচকদের আহ্বান জানান। লাভরভ বলেছেন, জেসিপিওএর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সব মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পূরণ করতে হবে। ইরানের দাবিও সেটাই। তবে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বজায় রাখতে চায়, যা ডোনাল্ড ট্রাম্প ও হোয়াইট হাউসে তাঁর উত্তরসূরি জো বাইডেন আরোপ করেছেন।
বাইডেন প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইরানের ওপর চাপ বজায় রেখেছে। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যা ইরানের আলোচকদের ভিয়েনায় পদ্ধতির সমালোচনা করতে প্ররোচিত করেছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস প্রস্তাব ২২৩১–এর পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে ইরানের ওপর মার্কিন একতরফা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল কাউন্সিলের বৈঠকে প্রতিবেদনটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
এদিকে পরমাণু চুক্তির ঘোর বিরোধী ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের জন্য চাপ অব্যাহত রেখেছে।