গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা চালায় রাশিয়া। এর জবাবে রাশিয়ার ওপর, বিশেষ করে অর্থনীতিকে লক্ষ্য করে পশ্চিমা দেশগুলো একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে থাকে। এমনকি সেই সব দেশে থাকা রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভও জব্দ করা হয়। এই হামলা শুরুর ঠিক এক মাস পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মস্কোর ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর ‘অভূতপূর্ব নিষেধাজ্ঞা’কে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, রাশিয়ার মুদ্রা ‘রুবল ধ্বংসস্তূপে’ পরিণত হয়েছে। তখন রুবলের মান প্রায় অর্ধেক কমে যায়। ৭ মার্চ ১ ডলার কিনতে খরচ হতো ১৪৩ রুবল।
রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রথম কয়েক সপ্তাহ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তখন মানুষ ব্যাংক থেকে যতটা সম্ভব অর্থ তুলতে শুরু করে। আমদানি করা জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় মানুষ যা পেরেছে সব কিনে রেখেছে। ফলে গত এপ্রিলে ভোক্তা মূল্যসূচক ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এর পরের মাসেই রুশ মুদ্রা রুবল ঘুরে দাঁড়ায়। জানুয়ারির তুলনায় ডলারের বিপরীতে রুবলের মান ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
আর এটি সম্ভব হয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নেওয়া অনেকগুলো পদক্ষেপের কারণে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ‘অবন্ধুসুলভ’ দেশগুলোকে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানির জন্য শর্ত বেঁধে দেওয়া। বলা হয়, ক্রেতাদের গ্যাসের মূল্য রুবলে পরিশোধ করতে হবে। এর জন্য তাদের রাশিয়ার রাষ্ট্রমালিকানাধীন জ্বালানি কোম্পানি গাজপ্রমের ব্যাংকে হিসাব খুলতে হবে এবং ইউরো ও ডলারে পরিশোধিত অর্থ রুবলে রূপান্তর করতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলেই গ্যাস সরবরাহ চুক্তি স্থগিত করবে মস্কো।
আইটিআই ক্যাপিটলের প্রধান বিনিয়োগ কৌশলবিদ ইস্কান্দার লুটস্কো আল-জাজিরাকে বলেন, তিনটি ঘটনা রুবলের মান বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। এগুলো হলে নিষেধাজ্ঞার কারণে তেলের মূল্যবৃদ্ধি, পুঁজি নিয়ন্ত্রণ, ডলারের চাহিদা হ্রাস, তেল ও গ্যাস রপ্তানির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার অতিরিক্ত তারল্য।
লুটস্কো বলেন, নিষেধাজ্ঞা ও পুঁজি নিয়ন্ত্রণ রুবলের জন্য সহায়ক হয়েছে।
গত সপ্তাহে রাশিয়া এক মাসের মধ্যে তৃতীয়বার নীতি সুদহার হ্রাস করেছে। ফলে রাশিয়ার ব্যাংক খাতে বৈদেশিক মুদ্রার অতিরিক্ত তারল্য সৃষ্টি হয়ে ডলারের মানও একটু কমে যায়, যা ঐতিহাসিকভাবে খুবই বিরল।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ব্যাচেস্লাভ মিশচেঙ্কো আল-জাজিরাকে বলেন, রুশ অর্থনৈতিক কর্তৃপক্ষ যুদ্ধের শুরুতেই মানুষের আবেগ ও ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া বেশ ভালোভাবেই সামাল দিতে পেরেছে।
মিশচেঙ্কো বলেন, প্রথম দিকে গ্রাহকেরা আতঙ্কে যা পাচ্ছিল সব কিনে নিচ্ছিল। এ কারণে তখন জিনিসের দাম বেড়ে যায়। কিন্তু এপ্রিলের শুরুতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। পণ্য আমদানিতে এখন কিছু সমস্যা হচ্ছে, তবে সেগুলো তেমন কিছু নয়। যতটা না অর্থনৈতিক কারণে পণ্যের দাম বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে মনস্তাত্ত্বিক কারণে।
গত মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করার বিষয়ে আলোচনা করেছে। তবে পুতিন বলেছেন, ইউরোপ নিজেদের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার কারণে ‘নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবে।’ এর ফলে জ্বালানির দাম ও মূল্যস্ফীতি হবে।
রাশিয়ার ছিল মধুচন্দ্রিমা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব মোকাবিলায় রাশিয়া সঠিক কৌশল নিতে পেরেছে। এখন প্রশ্ন হলো, পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কাটাতে পারবে তো?
লুটস্কো বলেন, নিষেধাজ্ঞার প্রথম কয়েক মাস রাশিয়ার অর্থনীতির জন্য ছিল অনেকটা ‘মধুচন্দ্রিমার মতো’। আবার ইউরোপের এই কঠিন নিষেধাজ্ঞার মুখে ‘রুশ সরকারের তেমন কিছু’ করারও ছিল না।
লুটস্কো আরও বলেন, বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া বিশ্বব্যাপী তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের প্রায় ২০ শতাংশ এবং গ্যাসের সাড়ে ১৭ শতাংশ রপ্তানি করে থাকে।
রুশ সরকার তার আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে তেল ও গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে, যা এখন তার বাজেটের ৬৫ শতাংশ, অথচ ইউক্রেন আক্রমণের আগে এটি ছিল মাত্র ৩০ শতাংশ।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে এক মাস ধরে নিজেদের মধ্য আলাপ–আলোচনা চালায়। তবে শেষ পর্যন্ত তারা সিদ্ধান্ত নেয়, এ বছরের শেষ নাগাদ ইইউ রাশিয়ার কাছ থেকে ৯০ শতাংশ তেল আমদানি কমাবে। গত বৃহস্পতিবার তারা এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে। এই দেশগুলোতে সমুদ্রপথে তেল যায়। তবে হাঙ্গেরি রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করতে পারবে। ভূমিবেষ্টিত দেশটি পাইপলাইনে সরবরাহ করা রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল।
ব্যাপক ছাড়
লুটস্কো বলেন, এই নিষেধাজ্ঞার কারণে বাজার অস্থিরতায় আদতে লাভ হয়েছে রাশিয়ারই। যেখানে আগে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ছিল ৬০ ডলার, এখন তা ১০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে রাশিয়া ৫৮ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত বাণিজ্য করে, যা দেশটির ইতিহাসে রেকর্ড।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছে বলে মন্তব্য করেন আইটিআই ক্যাপিটলের প্রধান বিনিয়োগ কৌশলবিদ ইস্কান্দার লুটস্কো। তিনি বলেন, এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, বিশেষ করে বিশ্বের বৃহত্তম তেল আমদানিকারকদের জন্য। তবে চীনের মতো অনেক দেশ এ থেকে লাভবান হচ্ছে। তারা রাশিয়ার কাছ থেকে বড় ছাড়ে বিপুল পরিমাণ তেল কিনে নিচ্ছে। এটি ওইসিডি ইউরোপ (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর মতো দেশের ভোক্তাদের জন্য আরও বেশি সমস্যাপূর্ণ।
আইটিআই ক্যাপিটলের প্রধান বিনিয়োগ কৌশলবিদ বলেন, ‘আমি মনে করি, এসব নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য মানসিক চাপ তৈরি করা। এটা দেখানো যে আমরা শুধু দেখছি না, ব্যবস্থাও নিচ্ছি। কিন্তু তারা প্রকৃত অর্থে দরিদ্র দেশগুলোর ওপর এর কী প্রভাব পড়বে, তা বিবেচনায় নেয়নি।’
সরবরাহ ব্যাহত
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ব্যাচেস্লাভ মিশচেঙ্কো বলেন, যখন নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষতির কথা আসে, তখন দেখা যায় ‘রাশিয়া ইইউ থেকে অনেক ভালো অবস্থায় আছে।’ পণ্যের চাহিদা আছে। বিশ্ববাজারে রাশিয়ার স্থান, বিশেষ করে জ্বালানি পণ্যের ক্ষেত্রে, অন্য কেউ নিতে পারবে না। রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে যত বেশি উত্তেজনা চলবে, গ্যাসের মতো কিছু পণ্যের দাম তত বাড়বে।
নানাভাবে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া রাশিয়ার রপ্তানির পরিমাণ কমলেও আয় বেড়েছে কয়েকগুণ। এটি ডলার ও ইউরোর ওপর চাপ তৈরি করেছে। বিপরীতে রুবলের মান বাড়ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় ৩৬ শতাংশ তেল ও ৪০ শতাংশের বেশি গ্যাস রাশিয়া থেকে আমদানি হয়ে থাকে।
মিশচেঙ্কো বলেন, কয়েক দশক ধরে রাশিয়া ভারত, চীন ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় রপ্তানি বিস্তৃত করছে। চীন এখন রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার, যেখানে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের আগে জার্মানি ছিল রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার।
একইভাবে ২০১৪ সালে রাশিয়া ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ খাদ্য আমদানিকারক। বাস্তবতা হলো, তারা আগে যে পরিমাণ খাদ্য আমদানি করত, এখন তার চেয়ে বেশি রপ্তানি করছে।
গত তিন মাসে ভারত আগের তুলনায় চার গুণ বেশি অপরিশোধিত তেল কিনেছে। এর মধ্য দিয়ে দেশটি এখন রাশিয়ার শীর্ষ অপরিশোধিত তেল ক্রেতা।
মস্কোর তেল রপ্তানি আয় এখন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। প্রতি মাসে ২০ বিলিয়ন ডলার আয় করছে তারা, যা ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ৫০ শতাংশ বেশি।
ইউরোপিয়ান ক্রেতাদের রাশিয়ার বিকল্প খুঁজতে হবে উল্লেখ করে মিশচেঙ্কো বলেন, সমস্যা হলো, জ্বালানির জন্য ইউরোপ রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে পার্শ্ববর্তী এত বড় রপ্তানিকারককে ফেলে দূরের কোনো অঞ্চল থেকে বিকল্প খুঁজে পাওয়া মোটেও সহজ হবে না। আমার মনে হয়, এই নিষেধাজ্ঞা উভয় পক্ষের জন্য ক্ষতিকর।’