পশ্চিমাদের কাছ থেকে যা চায়, যে কারণে চায় রাশিয়া
ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়া প্রায় এক লাখ সেনা মোতায়েন করেছে। এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী দেশগুলোয় সেনা মোতায়েন করছে এবং সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে। দুই পক্ষই একে অপরের ওপর দোষ চাপাচ্ছে; কিন্তু কেউই পিছু হটছে না।
পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধের আশঙ্কা যেমন বাড়ছে, তেমনি কূটনৈতিক তৎপরতাও বাড়ছে। ইউক্রেন ইস্যুতে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বৈঠক করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। বৈঠক শেষে লাভরভ আশার বাণী শোনালেও ব্লিঙ্কেন কূটনৈতিক কথাবার্তাই বলেছেন। কিন্তু রাশিয়ার পক্ষ থেকে একটি বিষয় জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে ‘নিরাপত্তাসংক্রান্ত নিশ্চয়তা’ দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে।
এই নিশ্চয়তার মধ্যেই রাশিয়ার বেশ কিছু চাওয়া লুকিয়ে রয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, রাশিয়া আসলে কী চায়? আর রাশিয়া যা চায়, ইউক্রেন ও পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষে এসব দেওয়া কতটা কঠিন?
রাশিয়ার অন্যতম স্পষ্ট চাওয়াটা হলো সোভিয়েত ইউনিয়নে একসময় ছিল—এমন কোনো দেশ, বিশেষ করে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে না। অর্থাৎ সাবেক সোভিয়েত এলাকায় ন্যাটো–বিস্তার বন্ধ করতে হবে স্থায়ীভাবে।
২০০৮ সালে ন্যাটো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, একসময় ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে ইউক্রেন। এ প্রতিশ্রুতিরই প্রত্যাহার চায় রাশিয়া। যদিও এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মত হলো ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে না। কারণ, সদস্য হওয়ার জন্য যেসব শর্ত পূরণ করতে হয়, তা পারেনি ইউক্রেন। কিন্তু রাশিয়া এভাবে চিন্তা করছে না। এ প্রসঙ্গে রুশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সের্গেই রিয়াকভের বক্তব্য হলো, ‘আমরা অপর পক্ষকে (ন্যাটো) বিশ্বাস করছি না।’ তাঁর বক্তব্য হলো, কোনো ধরনের প্রতিশ্রুতি নয়; রাশিয়ার ‘গ্যারান্টি’ লাগবে।
কিন্তু ন্যাটোর বক্তব্য হলো, যেকোনো দেশের অধিকার রয়েছে তার মিত্র বেছে নেওয়ার। সদস্যর নেওয়ার ক্ষেত্রে ন্যাটোর দ্বার উন্মুক্ত। জোরজবরদস্তি করে কিংবা পরাজিত করে কোনো দেশকে ন্যাটোর সদস্য করা হবে না।
রাশিয়ার চাওয়া যে শুধু ইউক্রেনেই সীমাবদ্ধ, এমনটা নয়; দেশটি চায়, পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর কোনো সামরিক উপস্থিতি থাকবে না। ‘নিরাপত্তাসংক্রান্ত নিশ্চয়তা’ চেয়ে একটি প্রস্তাব গত ডিসেম্বরে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে পাঠিয়েছিল রাশিয়া। এতে বলা হয়েছে, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয় ন্যাটোর সেনা মোতায়েন বা সামরিক উপস্থিতি রাখা যাবে না। কিন্তু এ অঞ্চলের দেশ এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মন্টেনেগ্রো, আলবেনিয়া, নর্থ মেডিসোনিয়া ও বুলগেরিয়া ন্যাটোর সদস্য। ফলে রাশিয়ার এ দাবি মেনে নিলে সদস্যদেশগুলোর নিরাপত্তা ইস্যুকে উপেক্ষা করা হবে।
কিন্তু এখানেই জটিলতাটা দেখা দিচ্ছে। বার্লিন প্রাচীর ভাঙার পর শান্তিপূর্ণভাবে পূর্ব ইউরোপ থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতিতেই সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ১৯৯৭ সালের পর থেকে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে সদস্য করে।
এ পদক্ষেপে খানিকটা ক্ষুব্ধ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি একে দেখছেন অন্যভাবে। মিত্র বাড়ানোর ক্ষেত্রে রাশিয়ার যে দুর্বলতা, তারই সুযোগ নিচ্ছে পশ্চিমারা—পুতিন বিষয়টিকে এভাবে দেখছেন।
কিন্তু পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর কোনো সামরিক উপস্থিতি থাকবে না—রাশিয়ার এ চাওয়াকে একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছে ন্যাটো। সেখানে সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর কারণ হিসেবে রাশিয়ার দিকেই আঙুল তুলছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স–বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডের মতে, ইউরোপের মধ্য ও পূর্বাঞ্চলে ন্যাটোর সেনা মোতায়েন করতে হবে—এ ভাবনা তাঁদের ছিল না। রাশিয়া ২০১৪ সালে ইউক্রেনে হামলা চালালে তাঁরা সেনা মোতায়েনের পদক্ষেপ নেন।
রাশিয়ার আরেকটি উদ্বেগের কারণ হলো ন্যাটোর ক্ষেপণাস্ত্র। ইউরোপে মধ্যপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষায় নিষেধাজ্ঞা চায় তারা। এ–সংক্রান্ত চুক্তিও হয়েছিল। ২০১৯ সালে মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে করা ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। তখন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ছিল রাশিয়া এ চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু রাশিয়া এর সঙ্গে একমত নয়। এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় বেজায় চটেছিলেন পুতিন। গত ডিসেম্বরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমরা কি যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তের কাছে রকেট মোতায়েন করেছি? না। আমরা এটা করিনি।’ এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের রকেট তাঁর দেশের দ্বারপ্রান্তে কড়া নাড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ভয় রাশিয়ার। রাশিয়ার আশঙ্কা, ন্যাটোর সদস্য হয়েও এ জোটের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পেতে পারে ইউক্রেনের সেনারা। এ ছাড়া ইউক্রেনের মাটিতে ন্যাটোর অস্ত্রের মজুত গড়ে উঠতে পারে। আর এই ইউক্রেন থেকে মস্কোয় আঘাত হানা সম্ভব।
রাশিয়ার এ দাবির সঙ্গে খানিকটা একমত ন্যাটো। তারা চায় চুক্তিটি পুনর্বহাল হোক। এ জন্য পদক্ষেপও নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্পের ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে বাইডেনের দলের বেশ কয়েকজন আইনপ্রণেতা।
২০১৫ সালের ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল। এই মিনস্ক চুক্তি অনুসারে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ও রাশিয়া–সমর্থিত বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘাতের অবসান হবে। এর মধ্য দিয়ে ইউক্রেনের ডনবাস এলাকায় বিদ্রোহীদের একধরনের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা। কিন্তু ইউক্রেন আর সেই পথে হাঁটছে না। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি চাইছেন, এ চুক্তি সংশোধন করা হোক। কিন্তু রাশিয়া বলছে, ২০১৫ সালের ওই চুক্তিতে ইউক্রেন যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে হবে। অর্থাৎ ওই এলাকায় একধরনের স্বায়ত্তশাসন চায় রাশিয়া।
এ বিষয়ে ন্যাটোর বক্তব্য হলো যুক্তরাষ্ট্র সেই মিনস্ক চুক্তিকে সমর্থন করে। কিন্তু ইউক্রেন এতে বেশি আগ্রহী নয়।
এসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একটাই প্রশ্ন উঠছে, রাশিয়া আসলে চাইছে কী? রাশিয়া প্রকাশ্যে এটা বলছে না। কিন্তু দেশটির আচরণে এটা পরিষ্কার হচ্ছে, পুতিন আসলে সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলে ফিরে যেতে চাইছেন। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙেছে; কিন্তু পুতিন এখনো ইউক্রেনকে ‘ঐতিহাসিক রাশিয়ার’ অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন।
বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, সোভিয়েত আবারও প্রতিষ্ঠা করতে চান পুতিন। রাশিয়া যদি তার ক্ষমতা বাড়াতে পারে, তবে তা পশ্চিমাদের ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
যেসব পদক্ষেপ সম্প্রতি পুতিন নিয়েছেন, তার মধ্য দিয়ে তিনি কিছু না কিছু অর্জন করবেন। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী উইলিয়াম কোহেনের বক্তব্য হলো, পুতিনের প্রতিটি পদক্ষেপ হিসাব করা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি বলেন, পুতিন এমন কিছু এখান থেকে পেতে যাচ্ছেন, যা তাঁকে তৃপ্তি দেবে। তিনি এটা নিশ্চিত করতে চাইছেন, ইউক্রেন কখনোই প্রকৃত স্বাধীনতা পাবে না, ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে না এবং বিধ্বংসী অস্ত্র নিজের কাছে রাখতে পারবে না।
রাশিয়া এই পথে হেঁটে অনেক কিছুই অর্জন করেছে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ডনবাসে রাশিয়াপন্থীরা শক্তিশালী হয়েছে। এখন ন্যাটোকে পূর্ব ইউরোপ থেকে হটাতে চাইছে। এখন উইলিয়াম কোহেনের কথা যদি বাস্তবে রূপ পায়, তাহলে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আসলেই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, সিএনএন, এএফপি, রয়টার্স, এনপিআর