জেলেনস্কি বুঝলেন, ‘কেউ কথা রাখেনি’
কথা তো ছিল কত কিছুই। পশ্চিমা বিশ্বের ক্ষমতাধরেরা কত প্রতিশ্রুতিই না দিয়েছিলেন। আর সেই প্রতিশ্রুতিতে ভরসা রেখে ন্যাটোতে যোগ দেওয়া ও আরও কত স্বপ্নই না দেখেছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তবে জেলেনস্কির সব স্বপ্ন এখন ভেঙে গেছে ক্ষেপণাস্ত্র, বোমা আর গোলায়।
রাশিয়া যখন একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান হামলা চালাচ্ছে, গোলা ছুড়ছে, শহর দখল করছে, তখন অনেক আকুতির পরও পশ্চিমা বন্ধুদের কাউকে পাশে পাচ্ছেন না জেলেনস্কি। হামলা শুরুর পর থেকে চার দিন ধরে একের পর এক ভিডিও বার্তায় জেলেনস্কির কথা শুনে মনে পড়ে যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই কবিতা—‘কেউ কথা রাখেনি’।
হামলার তৃতীয় দিন রাতে ইউক্রেনকে মানবিক ও সামরিক সহায়তা দিতে যুক্তরাজ্যসহ ২৬টি দেশ একমত হয়েছে। তবে ইউক্রেনে কোনো সামরিক সহায়তা পৌঁছানোর খবর এখনো পাওয়া যায়নি।
গত বৃহস্পতিবার ভোরে রাশিয়া হামলা শুরু করে ইউক্রেনে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের এ হামলায় অবশ্য অবাক হয়নি বিশ্ববাসী। কারণ, হামলার আশঙ্কা ছিল বেশ কয়েক দিন ধরেই। বারবারই ন্যাটোতে যুক্ত হতে চেয়েছে ইউক্রেন। আর সেখানেই আপত্তি ছিল রাশিয়ার। পুতিন মনে করেন, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়া তাঁর দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরোধিতাও করছেন তিনি।
তবে পুতিনের এমন বিরোধিতা আমলে নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। একই সুরে কথা বলেছে ন্যাটোও। বলেছে, ন্যাটো একটি আত্মরক্ষামূলক সামরিক জোট। প্রতিটি দেশের প্রতিরক্ষার পথ বেছে নেওয়ার অধিকার আছে। আর যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর এমন আশ্বাসে আস্থা রেখে জেলেনস্কিও তাঁর দাবিতে অনড় থেকেছেন। গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ভাদিম প্রাইস্তাইকো যুদ্ধে না জড়াতে প্রয়োজনে ন্যাটোয় যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকবে বলে জানালেও জেলেনস্কি উড়িয়ে দেন সমঝোতার সম্ভাবনা। তিনি বলেন, ন্যাটোর সদস্য পদ তার দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
আর এ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে জেলেনস্কি নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনলেন। নিজেদের নিরাপত্তার কথা বলে ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন বাড়াতে শুরু করে রাশিয়া। প্রায় কয়েক লাখ সেনা মোতায়েন নিয়ে উত্তেজনার মধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি দেশটির রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী-নিয়ন্ত্রিত দনবাসের দুটি অঞ্চল দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। এ দুই রাষ্ট্রের নিরাপত্তার কথা বলে গত বৃহস্পতিবার বন্ধু বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোকে ফোনে সামরিক অভিযান শুরুর খবর জানান।
রাশিয়ার হামলা শুরুর পর থেকে জেলেনস্কি বুঝতে পারেন, বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। আর এখন সেই বন্ধুই হাতড়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। ইউক্রেনের আকাশে রাশিয়ার একের পর এক বিমান হামলা, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, কামানের গোলাবর্ষণ চলছে। ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় মেলিতোপোল শহর দখলে নেওয়ার দাবি করেছেন রুশ সেনারা। হামলা শুরুর পর ৩ দিনে ইউক্রেনের ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মানুষ দেশ ছেড়েছেন বলে ধারণা জাতিসংঘের। রাজধানী কিয়েভও আক্রান্ত। প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে ইউক্রেন।
গত শুক্রবার কিয়েভে রাশিয়ার সেনাবাহিনী ঢুকে পড়ার পর জেলেনস্কি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘আজ সকালে আমরা একা আমাদের দেশকে রক্ষার জন্য লড়াই করছি। গতকালের মতোই বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো দূর থেকে কেবল সবকিছু দেখে যাচ্ছে।’ জেলেনস্কি বারবারই সামরিক সহযোগিতার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো সদস্যদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তবে যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে কেউ সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেনি। ইউক্রেনকে মানবিক ও সামরিক সহায়তা দিতে যুক্তরাজ্যসহ ২৬টি দেশ একমত হয়েছে। তবে ইউক্রেনে কোনো সামরিক সহায়তা পৌঁছানোর খবর এখনো পাওয়া যায়নি।
অবশ্য হামলা শুরুর পর থেকে আন্তর্জাতিক বিশ্ব যে একেবারে চুপচাপ বসে আছে, তা নয়। আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ‘সুইফট’ থেকে রাশিয়াকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে অন্য দেশগুলোকে রাজি করাতে ব্রিটিশ কূটনীতিদের চেষ্টার খবর শোনা গেছে। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, তাইওয়ানসহ বিভিন্ন দেশ। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড এর মধ্যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে এসব নিষেধাজ্ঞা মোটেই যথেষ্ট মনে করছেন না জেলেনস্কি। তাই হামলার দ্বিতীয় দিনে গতকাল শুক্রবার তিনি প্রশ্ন তুলে বলেছেন, কিয়েভে যে পরিস্থিতি, তাতে মনে হয় না এসব নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে।
হামলা শুরুর দিন থেকে কয়েকবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও বার্তায় এসেছেন জেলেনস্কি। দিনে তিন থেকে চারবার ভিডিও বার্তায় বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। প্রতিবারই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যুদ্ধে সহযোগিতার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। কাউকে পাশে না পাওয়ায় হতাশার কথাও বলেছেন অকপটে।
গতকাল গুঞ্জন ওঠে, জেলেনস্কি ইউক্রেন ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারেন। রুশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ডুমার স্পিকার ভিয়াচেসলাভ ভলোদিন দাবি করেন, জেলেনস্কি রাজধানী কিয়েভ ছেড়েছেন এবং দেশটির লিভ শহরে অবস্থান করছেন। তবে এ খবর যে সত্য নয়, তা প্রমাণের জন্য পরপর দুবার ভিডিও বার্তা দেন জেলেনস্কি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের বাসভবন গরোদেৎস্কি হাউসের সামনে ভিডিওতে জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি দেশেই আছেন। অস্ত্র ছাড়বেন না। দেশকে রক্ষা করবেন।
কয়েকটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমের খবরে জানানো হয়, ইউক্রেন যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা না দিলেও যুক্তরাষ্ট্র সরকার জেলেনস্কিকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে জেলেনস্কি সে প্রস্তাবে রাজি না হয়ে বলেছেন, ‘এখানে লড়াই হচ্ছে, আমার গোলাবারুদ দরকার, আমাকে সরিয়ে নেওয়ার দরকার নেই।’
ইউক্রেনে যে গোলাবারুদ দরকার, তা বোঝা গেছে এএফপির প্রকাশিত একটি ছবিতে। ওই ছবিতে কিয়েভে ইউক্রেনীয় এক সেনাকে অবিস্ফোরিত শেল কুড়াতে দেখা গেছে। ছবিটি তোলার আগে ওই এলাকায় রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ হয়েছে। হামলা শুরুর চার দিন পর ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসের অস্ত্র পাঠানোর খবর মিলেছে। তবে ইউক্রেনে এখন পর্যন্ত কোনো অস্ত্র পৌঁছায়নি।
শুধু জেলেনস্কি নয়, ক্ষুব্ধ ইউক্রেনের অন্য নেতারাও। ইউক্রেন পার্লামেন্টের সদস্য ও গলস পার্টির নেতা কিরা রুদিক বলেন, ‘রাশিয়ার সেনাবাহিনীর হামলা থেকে সুরক্ষার জন্য কেউ আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি।’ তিনি নিজেও অস্ত্র হাতে লড়তে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন। অস্ত্র হাতে লড়াই করতে প্রস্তুত হয়েছেন ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্টও। পেত্রো পোরোশেঙ্কো কিয়েভের রাস্তায় অস্ত্র হাতে সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।
একদিকে কিয়েভে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন জেলেনস্কি। অন্যদিকে বিপদে বন্ধুদের পাশে না পেয়ে শত্রুর সঙ্গেই সমঝোতার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং পুতিনকে ফোন করার পর রাশিয়া বেলারুশে ইউক্রেনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিয়েছে। ইউক্রেন সেই প্রস্তাব খতিয়ে দেখছে।
কৌতুক অভিনেতা ছিলেন জেলেনস্কি। কাজ করেছেন রুশ ও ইউক্রেনীয় ভাষার অনেক চলচ্চিত্রে। জনপ্রিয়তাও ছিল তুঙ্গে। ২০১৯ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হন। রুপালি পর্দার এই কৌতুক অভিনেতা বাস্তবজীবনে চরম বিপর্যয়ের সময়ে নিজেই যেন কৌতুকের শিকার হলেন। জেলেনস্কি বুঝলেন, যুদ্ধের চার দিন কেটে গেলেও কেউ কথা রাখেনি।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, স্পুতনিক, আরটি, আল জাজিরা, টুইটার, সিএনএন