গোয়েন্দা থেকে ক্ষমতার কেন্দ্রে পুতিন
২২ বছর ধরে রাশিয়ার ক্ষমতায় ভ্লাদিমির পুতিন। দীর্ঘ এই শাসনকালে দেশের অভ্যন্তরে ও বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে ‘দারুণ’ কৌশল দেখিয়েছেন তিনি। তাঁর মূলমন্ত্র কী?
২০১৫ সালে পুতিনের এক মন্তব্যে এই প্রশ্নের উত্তর মেলে। তিনি বলেছিলেন, জন্মস্থান লেনিনগ্রাদের ‘পথঘাট’ তাঁকে একটি বিষয় শিখিয়েছে। আর তা হলো—লড়াই অনিবার্য হলে প্রথমেই আঘাত হানো।
ঠিক এই কাজটিই ইউক্রেনে করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। গত সপ্তাহে ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান চালানোর আদেশ দিয়ে তিনি এখন সারা বিশ্বে আলোচিত-সমালোচিত। পশ্চিমারা তাঁকেসহ তাঁর দেশের ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে জাতিসংঘ। কিন্তু যা কিছুই হোক না কেন, পুতিন তাঁর অবস্থানে অনড়। তিনি যেকোনো মূল্যে ইউক্রেনকে ‘নিরস্ত্র’ করতে বদ্ধপরিকর।
পুতিন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ‘ভূরাজনৈতিক বিপর্যয়’ হিসেবে দেখেন তিনি। এই দর্শন থেকে তিনি রাশিয়াকে বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্রে আনতে মরিয়া।
বিশ্ব এখন যে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী পুতিনকে দেখছে, তাঁর উত্থান বেশ নাটকীয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন লেনিনগ্রাদে (বর্তমানে সেন্ট পিটার্সবার্গ) পুতিনের জন্ম ১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর। বাবা স্পিরিডোনোভিচ পুতিন, মা মারিয়া ইভানোভানা পুতিনা। এই দম্পতির তিন ছেলের মধ্যে পুতিন সবার ছোট। দরিদ্র পরিবারের সন্তান পুতিন বেড়ে ওঠেন লেনিনগ্রাদে।
আইনশাস্ত্রে পড়ালেখা করে ১৯৭৫ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন পুতিন। ছোটবেলার স্বপ্ন পূরণে একই বছর তিনি যোগ দেন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবিতে। সেখানে তিনি ছিলেন ১৫ বছর। কাজের সুবাদে ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছিলেন পূর্ব জার্মানিতে। এরপর সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে পুতিনের রাজনৈতিক উত্থান ঘটে। তিনি সেখানকার মেয়রের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে মস্কোতে ডাক পড়ে পুতিনের। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর রাশিয়ার প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের অধীনে ক্রেমলিনে কাজ করার সুযোগ পান তিনি।
পুতিনকে কেজিবির উত্তরসূরি গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবির প্রধান করেন ইয়েলৎসিন। তিনিই ১৯৯৯ সালের আগস্টে পুতিনকে প্রধানমন্ত্রী করেন। চেচনিয়ায় যুদ্ধ পরিচালনা করায় পুতিনের জনপ্রিয়তা বাড়ে। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে ইয়েলৎসিন হঠাৎ পদত্যাগ করলে রাশিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান পুতিন। তিনি রাশিয়াকে পুনর্গঠনের অঙ্গীকার করেন।
২০০০ সালের মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুতিন ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়ে সহজেই জয়লাভ করেন। ২০০৪ সালে তিনি দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হন। ২০০৮ সালে পুতিন তাঁর প্রেসিডেন্টের মেয়াদের দ্বিতীয় দফা পূর্ণ করেন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে তাঁর টানা তৃতীয় দফায় প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে থাকা সম্ভব ছিল না। এ কারণে তিনি নিজের ঘনিষ্ঠ দিমিত্রি মেদভেদেভকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দিয়ে নিজে হন প্রধানমন্ত্রী। তবে ক্ষমতার নাটাই তাঁর হাতেই থাকে।
মেদভেদেভ রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের মেয়াদকাল ৪ থেকে বাড়িয়ে ৬ বছর করেন, যা ২০১২ সাল থেকে কার্যকর হয়। ওই বছর পুতিন তৃতীয় দফায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হন। ২০১৮ সালে তিনি চতুর্থ দফায় প্রেসিডেন্ট হন। এই দফার মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালে।
অবশ্য সাংবিধানিক সংস্কারের অংশ হিসেবে ছয় বছর করে আরও দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট পদে থাকার সুযোগ রেখে করা আইন ২০২১ সালের এপ্রিলে চূড়ান্ত অনুমোদন দেন পুতিন। ফলে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত তাঁর জন্য রাশিয়ার ক্ষমতায় থাকার পথ উন্মুক্ত।
বর্তমান রাশিয়ার সর্বস্তরে পুতিনের একক কর্তৃত্ব বলবৎ রয়েছে। তিনি বিরোধীদের কঠোর হাতে দমন করে চলেছেন। এ নিয়ে পশ্চিমাদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সমালোচনা কানে তুলছেন না তিনি।
পুতিন রাশিয়াকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মতো দেশ মস্কোকে সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। যার সর্বশেষ নিদর্শন পশ্চিমাদের হুমকি উপেক্ষা করেই ইউক্রেনে পুতিনের আগ্রাসন।
৬৯ বছর বয়সী পুতিন রুশ সমাজের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাশিয়ার প্রভাব বাড়াতে তৎপর রয়েছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ‘ভূরাজনৈতিক বিপর্যয়’ হিসেবে দেখেন তিনি। এই দর্শন থেকে তিনি রাশিয়াকে বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্রে আনতে মরিয়া। তার অংশ হিসেবে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখলে নেন তিনি। সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সেখানকার যুদ্ধের সব হিসাব-নিকাশও বদলে দিয়েছেন তিনি। পুতিন রাশিয়াকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মতো দেশ মস্কোকে সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। যার সর্বশেষ নিদর্শন পশ্চিমাদের হুমকি উপেক্ষা করেই ইউক্রেনে পুতিনের আগ্রাসন।
সুপরিচিত মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস-এর বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির তালিকায় চারবার শীর্ষস্থান পাওয়া পুতিনকে রাশিয়ায় তাঁর সমর্থকেরা ‘ত্রাতা’ হিসেবে দেখেন। তাঁদের দৃষ্টিতে, রাশিয়ার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করছেন পুতিন। তবে সমালোচকের দৃষ্টিতে তিনি গণতন্ত্র থেকে রাশিয়াকে বহু দূরে নিয়ে গেছেন। তার জায়গায় চালু করেছেন ‘নিজস্ব শাসনব্যবস্থা’।
গত সপ্তাহে ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান চালানোর আদেশ দিয়ে তিনি এখন সারা বিশ্বে আলোচিত-সমালোচিত।
পুতিনের শাসনামলে রাশিয়ার অর্থনীতিও এগিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের উপাত্ত বলছে, ২০০০ সালে রাশিয়ার মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৭১০ মার্কিন ডলার (অ্যাটলাস মেথডে চলতি মূল্যে)। ২০২০ সালে তা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৯০ ডলারে। অবশ্য স্বজনতোষী পুঁজিবাদ বা ক্রনি ক্যাপিটালিজমের সুযোগ নিয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠরা ধনী থেকে অতিধনী হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ইউক্রেনে সামরিক অভিযানে সাফল্য এলে বিশ্ব পরিসরে এবং রাশিয়ার অভ্যন্তরে পুতিনের প্রভাব বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। বিপরীত ইউক্রেনে কৌশলগত ব্যর্থতা বিশ্বে রাশিয়ার প্রভাব খর্ব করতে পারে। বিশ্বে রাশিয়া একঘরে হয়ে যেতে পারে। এক জোট পশ্চিমা দেশগুলোর রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ, বৈশ্বিক লেনদেন ব্যবস্থা সুইফট থেকে দেশটির কয়েকটি ব্যাংককে বের করে দেওয়ার উদ্যোগ, আকাশ পথে নিষেধাজ্ঞা এবং ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে পুতিনের সামনে এক কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। চূড়ান্তভাবে কী হয়, সেটা বোঝা যাবে আগামী দিনগুলোর ঘটনাপ্রবাহে। অবশ্যই তাতে কেন্দ্রীয় চরিত্রের একটি থাকবেন পুতিন।
তথ্যসূত্র: এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, বিবিসি, বিজনেস ইনসাইডার, এএফপি, রয়টার্স।