খেলায় পুরোনো চাল দিলেন পুতিন

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনছবি: এএফপি

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গতকাল সোমবার পূর্ব ইউক্রেনের রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী–নিয়ন্ত্রিত দনবাসের দুটি অঞ্চলকে স্বাধীন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। একই সঙ্গে ‘প্রজাতন্ত্র’ দুটিতে রুশ সেনাদের শান্তিরক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। পুতিনের এই পদক্ষেপকে তাঁর খেলার পুরোনো চাল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে সিএনএনের এক বিশ্লেষণে।

২২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত সিএনএনের বিশ্লেষণে বলা হয়, পূর্ব ইউক্রেন নিয়ে সর্বশেষ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে পুতিন রাশিয়াকে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন।

পুতিন গতকাল যেসব ঘোষণা দিয়েছেন, তার ঠিক আগের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করেছেন সিএনএনের নাথান হাজ। তাঁর ভাষ্যমতে, পুতিন তাঁর দিনটিকে (সোমবার) একটি রাজনৈতিক নাট্যশালা হিসেবে সাজান। তিনি ক্রেমলিনে তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি সভা করেন, যা টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়। এ ধরনের সভা প্রকাশ্যে হয় না। ফলে, তা ছিল লোকদেখানো।

আড়ম্বরপূর্ণ এই সভায় পুতিন তাঁর শীর্ষ নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের কাছ থেকে পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে যুক্তি শোনেন।

সভায় পুতিনের উপদেষ্টারা তাঁদের উদ্যম দেখাতে তৎপর ছিলেন। যেমন রাশিয়ার বৈদেশিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান সের্গেই নারিশকিন বলেন, তিনি দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন হিসেবে রাশিয়ার স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিকে সমর্থন করেন। সঙ্গে নারিশকিন যোগ করেন, তিনি রাশিয়া ফেডারেশনে এই দুটি অঞ্চলের অন্তর্ভুক্তিও সমর্থন করেন।

এ সময় পুতিন হেসে বলেন, ‘আমরা আজ এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি না।’

সিদ্ধান্ত না জানিয়েই দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সভার কার্যক্রম সম্প্রচার আকস্মিকভাবে শেষ করে।

পরে ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে বলা হয়, দনবাসের দুটি অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবেন পুতিন।

কিছুক্ষণ পরে আবার নাটক শুরু হয়। এ পর্যায়ে পুতিন একটি লম্বা ভাষণ নিয়ে টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হন।

কিন্তু পুতিন শুরুতেই উত্তেজনায় পানি ঢেলে দেন। তিনি মূল ঘোষণায় যাওয়ার আগে দীর্ঘ বক্তৃতা দেন। এ বক্তৃতায় তিনি ইতিহাস তুলে ধরেন।

পুতিন তাঁর ভাষণে ইউক্রেনকে রাশিয়ার ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, পূর্ব ইউক্রেন একসময় রাশিয়ার ভূমি ছিল। একটি সত্যিকারের জাতিরাষ্ট্র হওয়ার ইতিহাস ইউক্রেনের নেই।

ইতিহাসের প্রতি পুতিনের আবেগ নতুন কিছু নয়। গত গ্রীষ্মে তিনি পাঁচ হাজারের বেশি শব্দের একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। এ প্রবন্ধ মূলত ইউক্রেনের রাষ্ট্র হওয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।

এখন পুতিনের ইতিহাস-সম্পর্কিত আবেগ তাঁর দেশকে পশ্চিমাদের সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘাতের একটি নতুন ও উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ইউক্রেনে যে সংকট চলছে, তা একটি বিপর্যয়কর নতুন যুদ্ধের হুমকি সৃষ্টি করেছে।

পুতিন যেভাবে ইতিহাসের সাধারণীকরণ করছেন, এর সঙ্গে পেশাদার ইতিহাসবিদেরা দ্বিমত পোষণ করে থাকেন।

ইতিহাসের যে বয়ান পুতিন দিচ্ছেন, তার অর্থ দাঁড়ায়, ভ্লাদিমির লেনিন ও বলশেভিকরা ইউক্রেন প্রজাতন্ত্র তৈরি করেছিলেন। জোসেফ স্তালিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একে প্রসারিত করেছিলেন। তারপর নিকিতা ক্রুশ্চেভ কোনো এক অজানা কারণে রাশিয়ার কাছ থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ কেড়ে নিয়ে ইউক্রেনকে উপহার দিয়েছিলেন।

পুতিন যে দেশকে রাশিয়ার হাতে সৃষ্টি বলছেন, অথচ সেই ইউক্রেনের জন্যই হাজারো ইউক্রেনীয় লড়াই করছেন। প্রাণ হারাচ্ছেন।

তাই গতকাল পুতিন যে ‘ঐতিহাসিক’ বক্তৃতা দিলেন, তা বর্তমান সংকটকে খুব কমই স্পর্শ করে। ফলে, এটা প্রতীয়মান হয় যে রুশ প্রেসিডেন্টকে ইতিহাসের ভূত তাড়া করছে।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন থেকে সৃষ্ট কতিপয় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদী দ্বন্দ্ব-সংঘাতের জন্ম নেয়। যেমন মলদোভার ট্রান্সনিস্ট্রিয়া, জর্জিয়ার অভ্যন্তরের আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওসেটিয়া। এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ এলাকায় নিজেকে কাগজে-কলমে ‘শান্তিরক্ষী বাহিনী’ হিসেবে সন্নিবেশিত করে রাশিয়া। কিন্তু বাস্তবে মলদোভা ও জর্জিয়ার মতো দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে ক্ষুণ্ন করছে রাশিয়া।

ঠিক একই খেলা এখন ইউক্রেনের দনবাসে খেলছেন পুতিন।

ইউক্রেনের দনবাসের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে রাশিয়া বলছিল, অঞ্চল দুটির বিচ্ছিন্নতাবাদীরা স্থানীয় বাসিন্দা। তাঁরা আত্মরক্ষার জন্য কিয়েভ সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন। রাশিয়া মুখে এ কথা বললেও অঞ্চল দুটির বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তারা অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল, যার প্রমাণও রয়েছে।

এখন রাশিয়া এসব কথা বাদ দিয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ‘ইউক্রেনীয়দের মধ্যকার সংঘাতে’ যুক্ত একটি পক্ষের প্রকাশ্য পক্ষ নিয়েছেন।

সিএনএন অবলম্বনে