গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়া। এরপর তিন সপ্তাহ গড়িয়েছে। হামলায় বিধ্বস্ত হয়েছে শহরের পর শহর। মৃত্যু হয়েছে হাজারো মানুষের। আশপাশের দেশগুলোতে শরণার্থী হিসেবে পাড়ি জমিয়েছেন লক্ষাধিক ইউক্রেনীয়।
এমন পরিস্থিতিতে সেই পুরোনো প্রশ্নই আবার উঠে আসছে—ইউক্রেনে হামলার পেছনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের উদ্দেশ্যটা কী? আর যুদ্ধ থেকে বের হওয়ার কোনো পথ আছে কি না? বিবিসির এক বিশ্লেষণে এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
পুতিন কী চান
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলাকে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ বলে আখ্যা দিয়েছেন পুতিন। একে আগ্রাসন বা যুদ্ধ বলে স্বীকার করেননি তিনি। তবে এটা পরিষ্কার যে একে রাশিয়ার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে দেখছেন তিনি।
অভিযান শুরুর প্রথমদিকে রুশ প্রেসিডেন্টের লক্ষ্য ছিল ইউক্রেনের বর্তমান সরকারকে উৎখাত করা। এই সরকার পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দিতে তৎপর ছিল। তাই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটির ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পথ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন পুতিন।
অভিযানের উদ্দেশ্য নিয়ে রাশিয়ার নাগরিকদেরও একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন পুতিন। বলেছিলেন, ইউক্রেনকে সামরিকীকরণের প্রক্রিয়া বন্ধ ও নাৎসি প্রভাবমুক্ত করতে চান তিনি। দেশটির দনবাস অঞ্চলে সরকার গণহত্যা চালাচ্ছে—এ দাবি করে সেখানকার বাসিন্দাদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতিও দেন।
ইউক্রেন দখলের কোনো পরিকল্পনা রাশিয়ার নেই উল্লেখ করে পুতিন বলেন, ‘আমরা জোর করে কারও ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না।’
তবে ইউক্রেনের সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা থেকে রাশিয়া পিছু হটেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের বৈঠক থেকে এটাই মনে হয়েছে, রাশিয়া এখন ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ করার পথে হাঁটছে।
কেন নিরপেক্ষ ইউক্রেন চান পুতিন
ইউক্রেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা পায় দেশটি। এর পর থেকেই ইউক্রেন পশ্চিম, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও ন্যাটোর দিকে ঝুঁকেছে।
ইউক্রেনের এ অবস্থানের পরিবর্তন আনতে চান পুতিন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে ‘ঐতিহাসিক রাশিয়ার বিচ্ছেদ’ হিসেবেই দেখেন তিনি। পুতিনের নানা কথাবার্তায় তাঁর এ ধারণা স্পষ্ট হয়েছে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার বাসিন্দাদের এক হিসেবে দাবি করেছেন তিনি। ইউক্রেনের কখনোই প্রকৃত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার ঐতিহ্য ছিল না বলেও উল্লেখ করেছেন।
২০১৪ সাল পর্যন্ত ইউক্রেনে ক্ষমতায় ছিলেন রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। এক বছর আগে ২০১৩ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একটি চুক্তিতে না যেতে তাঁকে চাপ দেন পুতিন। এর জের ধরে ইউক্রেনে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পতন হয় ইয়ানুকোভিচ সরকারের।
এর জবাবে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে নেয় রুশ সেনাবাহিনী। পাশাপাশি দেশটির পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দেয় মস্কো। এরপর আট বছর ধরে ইউক্রেনের সেনাদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংঘাত চলছে। এতে প্রাণ হারিয়েছে ১৪ হাজার মানুষ।
পরে ২০১৫ সালে দুই পক্ষ অস্ত্রবিরতিতে একমত হয়। বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে একটি শান্তিচুক্তিও হয়। তবে সেই চুক্তি কখনোই আলোর মুখ দেখেনি। গত মাসেই ওই শান্তিচুক্তির পাশ কাটিয়ে ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন পুতিন।
ইউক্রেনে অভিযানের সময় পুতিন অভিযোগ করে বলেন, একক জাতি হিসেবে ইউক্রেন ও রাশিয়ার ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলছে ন্যাটো। জোটটি ক্রিমিয়ায় যুদ্ধ ডেকে আনতে চায়।
যুদ্ধ থেকে বের হওয়ার পথ কী
ইউক্রেনের হামলা বন্ধে কয়েকটি শর্ত দিয়েছিলেন পুতিন। এর মধ্যে ছিল দখল করা ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না।
তবে এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। পুতিন তাঁর দাবি শিথিল করেছেন বলে জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোলিয়াক। কিছুদিনের মধ্যে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতিও হতে পারে বলে বিশ্বাস তাঁর।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান আরপলিটিক ও কার্নেগি মস্কো সেন্টারের গবেষক তাতিয়ানা স্টানোভায়া বলেন, ‘মনে হচ্ছে পুতিনকে দাবির সংক্ষিপ্ত তালিকা মেনে নিতে হবে।’
আপাতত যুদ্ধবিরতির ওপর জোর দিয়ে বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ক্রিমিয়া ও রাশিয়ার স্বীকৃতি পাওয়া দোনেত্স্ক ও লুহানস্কের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে সমঝোতা বেশ দূরে। ইউক্রেন ও রাশিয়া যদি এ নিয়ে পরে আলোচনা করতে চায়, তা হয়তো সমস্যা ডেকে আনবে না।
ইউক্রেন সংকট সমাধানে আলোচনার আগে যুদ্ধবিরতির প্রয়োজন বলে মনে করেন ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ-ইভেস লে ড্রিয়ান। তিনি বলেন, ‘মাথায় বন্দুক ধরে রেখে আপনি আলোচনা করতে পারেন না।’
ইউক্রেন কী চায়
ইউক্রেনের দাবিগুলো বেশ পরিষ্কার বলে উল্লেখ করেছেন মিখাইলো পোদোলিয়াক। এর মধ্যে রয়েছে, যুদ্ধবিরতি ও ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার। পাশাপাশি এমন একটি জোটের কাছ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাওয়া, যারা যুদ্ধের সময় ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়াবে।
জাতিসংঘের মধ্যস্থতাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক মার্ক ওয়েলার বলেন, রুশ সেনা প্রত্যাহার শুধু ইউক্রেনেরই দাবি না, পশ্চিমারাও এটাই চায়।
এদিকে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর থেকে ন্যাটো ইস্যুতে সুর নরম করেছে ইউক্রেন। সম্প্রতি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ইউক্রেনীয়রা এখন বুঝতে পেরেছে ন্যাটো তাদের সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেবে না।