এবার কোথায় যাবে ক্রিমিয়ার তাতার মুসলিমরা
ইরফান কুদুসোভের বয়স ৫৩ বছর। বসবাস করেন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে। সেখানে একটি রেস্তোরাঁ চালান তিনি। ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপদ্বীপ ক্রিমিয়ার সংখ্যালঘু তাতার মুসলিম জনগোষ্ঠীর একজন ইরফান। সাবেক সোভিয়েত সরকারের রোষানলের কারণে তুর্কি বংশোদ্ভূত তাতার মুসলিম জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ক্রিমিয়া থেকে নির্বাসিত ছিলেন। বয়স যখন ২০–এর কোঠায়, তখন ইরফান মধ্য এশিয়া থেকে অন্য অনেক তাতারের মতো ক্রিমিয়ায় ফেরেন।
ওই দিনের স্মৃতিচারণা করে ইরফান বলেন, ‘সে এক সুখের দিন। বয়স্ক ব্যক্তিরা যখন উড়োজাহাজ থেকে ক্রিমিয়ায় নামলেন, তখন তাঁরা মাটিতে চুমু এঁকে দিয়েছিলেন। মাতৃভূমিতে ফেরার আনন্দে আমরা সবাই তখন কাঁদছিলাম।’
তবে পরিস্থিতি বদলে যায় ২০১৪ সালে, রাশিয়া ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলে নিলে। ইরফানসহ প্রায় ১০ হাজার তাতার মুসলিমকে আবারও মাতৃভূমি ছাড়তে হয়। তখন থেকেই ইরফান কিয়েভে বসবাস করছেন। এখন এক লাখের বেশি রুশ সৈন্য ইউক্রেন সীমান্তে জড়ো হয়েছে। যেকোনো সময় রাশিয়া দেশটিতে সামরিক আগ্রাসন চালাতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। যুদ্ধ বাধলে সেটা শুধু রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। অনিবার্যভাবে এতে পশ্চিমারাও জড়িয়ে পড়বে। তাই ইউক্রেনে রুশ হস্তক্ষেপের আশঙ্কায় নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন ঝুঁকিতে পড়েছে তাতার জনগোষ্ঠীর মানুষ।
বাধ্যতামূলক নির্বাসন
তাতাররা কৃষ্ণসাগরের উত্তরাঞ্চলে ক্রিমিয়া উপত্যকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী । ১৯৪৪ সালে ক্রিমিয়ায় প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার তাতার বসবাস করত। তাদের মূল পেশা ছিল পশুপালন। তখন ক্রিমিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত। সোভিয়েত শাসক জোসেফ স্তালিনের রোষানলে পড়ে তাতাররা মধ্য এশিয়ায়, বিশেষত উজবেকিস্তানে পাড়ি জমাতে বাধ্য হন। বলা হয়ে থাকে, কষ্টকর এ যাত্রায় ক্ষুধা, শীত ও রোগে প্রায় অর্ধেক তাতার মারা যান। এ ঘটনাকে গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে ইউক্রেনসহ কয়েকটি দেশ।
একসময় কয়েক হাজার তাতার সোভিয়েত রেড আর্মিতে কর্মরত ছিলেন। এরপরও জোসেফ স্তালিন বিশ্বাস করতেন, তাতাররা নাৎসিদের অনুগত। সোভিয়েত আমলে তাতারদের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে এমন প্রচারণা চালানো হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে স্তালিনের গোস্সার এটাই কারণ। তিনি ক্রিমিয়ায় তাতারদের নিজস্ব ভাষাচর্চায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। এসব কারণে অতীত থেকেই তাতাররা সোভিয়েতবিরোধী মনোভাব পোষণ করেন। সেই রেশ এখনো রয়ে গেছে। সোভিয়েতের জায়গায় শুধু বসেছে রাশিয়া।
ইউক্রেনবাসীর ভাগ্য এখন অনেকটাই ঝুলে রয়েছে চলমান সংকট নিরসনে চলা বিশ্বনেতাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ওপর। ইউক্রেন আমাদের জন্মভূমি। এখানে কী ঘটতে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত চিন্তা করি। আমাদের ভাগ্যে কী পরিণতি লেখা রয়েছে, সেটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন থাকি
তাতারদের কপাল খোলে ১৯৯১ সালের পর। তত দিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। ইউক্রেন স্বাধীন হয়েছে। রাশিয়া নয়, ইউক্রেনের অংশ হয়েছে ক্রিমিয়া। ইউক্রেন সরকার তাতারদের মাতৃভূমিতে ফেরার অনুমতি দেয়। তবে ফিরে এলেও তাঁরা ফেলে যাওয়া ঘরবাড়িতে উঠতে পারেননি, সেসব দখল হয়ে গিয়েছিল। কিয়েভে বসবাসকারী জাখিদা কাতাকি বলেন, ‘আমার দাদি তাঁর ফেলে যাওয়া বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেটির নতুন মালিক তাঁর সঙ্গে ভীষণ খারাপ ব্যবহার করেন।’
পরের সময়টা ক্রমশ উত্থানের, ভালো থাকার। সোভিয়েত পতনের বছরই ক্রিমিয়ায় তাতারদের প্রতিনিধিত্বকারী কর্তৃপক্ষ ‘মজলিশ’ গঠিত হয়। ক্রিমিয়ায় তাতার ভাষায় বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। তাতাররা নতুন করে থিতু হওয়ার, ঘুরে দাঁড়ানোর, জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখেন। তবে এ স্বপ্ন ভেস্তে যায় ক্রিমিয়া রাশিয়ার হাতে চলে যাওয়ায়। এর পর থেকে রাশিয়া-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে ইউক্রেনের সেনাদের লড়াই চলছে। এ লড়াইয়ে অন্তত ১৪ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল
২০১৪ সালের মার্চে রুশ সেনারা ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিলে প্রায় ৩০ হাজার তাতার ইউক্রেনে পাড়ি জমান। কেননা, রুশ সেনারা তাতারদের ওপর চরম দমনপীড়ন চালায়। ওই সময় ইরফান তাঁর স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে ক্রিমিয়া ছেড়ে কিয়েভে চলে যান। পরে রাশিয়া সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ তুলে তাতারদের ‘মজলিশ’ নিষিদ্ধ করে। তাতারদের টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ধারণা করা হয়, ওই সময় তাতারদের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ ইউক্রেনে পাড়ি জমান। বেশির ভাগ কিয়েভ কিংবা দক্ষিণের শহর খেরসনে আশ্রয় নেন। ইরফান বলেন, ‘ভেবেছিলাম অচিরেই ক্রিমিয়া ইউক্রেনের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। আমরা আবারও ক্রিমিয়ায় ফিরতে পারব।’ ইরফানের আশা পূরণ হয়নি।
সোরিনা সেইতভেলিয়েভের স্বামী একজন তাতার। স্বামী-স্ত্রী মিলে এখন কিয়েভে একটি রেস্তোরাঁ চালান। সোরিনা বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, একদিন ক্রিমিয়া আবারও ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে আসবে। জোর করে দখলের জন্য রাশিয়াকে মূল্য দিতে হবে।’
যদিও রাশিয়া ইতিমধ্যে ক্রিমিয়ার অবকাঠামো উন্নয়নে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। নির্মাণ করা হচ্ছে হাসপাতাল, সড়ক, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সংযোগ লাইন। ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু বানানো হয়েছে। তবে এসব উদ্যোগে জায়গা হয়নি তাতারদের।
কিয়েভে তাতারদের জীবন
কিয়েভের সড়কে বের হলে আশপাশে চোখে পড়বে তাতারদের অসংখ্য রেস্তোরাঁ। পশুপালন ছেড়ে তাতাররা এখন রেস্তোরাঁ শিল্পে থিতু হয়েছেন। কিয়েভের যেখানে-সেখানে উড়তে দেখা যায় তাতারদের স্বতন্ত্র পতাকা। সোরিনা জানান, নতুন করে ক্রিমিয়া ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পর তাতারদের মধ্যে ঐক্য বেড়েছে। নিজেদের পেশা এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে তাতাররা আরও বেশি সচেতন হয়েছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তাতারদের জীবনমানের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে ইউক্রেন সরকার ও বেসরকারি অধিকার সংগঠনগুলো। কিয়েভের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ক্রিমিয়ান হাউসে তাতারদের ইতিহাস ও শিল্প নিয়ে একটি প্রদর্শনী চলছে। সেখানে ২০ বছর বয়সী শিক্ষার্থী পোলিনা নেসতেরোভা বলেন, ‘ক্রিমিয়ান তাতাররা নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি ভীষণ শ্রদ্ধাশীল। তাঁরা কখনোই এটিকে হারাতে চান না। তবে বারবার তাঁদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হতে হচ্ছে। তাঁরা একদিন অবশ্যই ক্রিমিয়ায় ফিরতে ও সেখানে শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন।’
কিয়েভে বর্তমানে প্রায় এক লাখ মুসলিম বসবাস করছেন। তাঁদের মধ্যে ক্রিমিয়া থেকে আসা তাতাররা ছাড়াও উজবেকিস্তান, আজারবাইজান, কাজাখস্তান থেকে আসা মানুষ রয়েছেন। শহরের আর-রাহমা মসজিদে মুসলিম শিশুরা নিজেদের মাতৃভাষা শিখতে ও সেই ভাষায় পড়াশোনা করতে পারে।
বাড়ছে উদ্বেগ-অনিশ্চয়তা
ক্রিমিয়া ছেড়ে আসা ৪৪ বছর বয়সী মারলেন কাতাকি মনে করছেন, রুশ আগ্রাসনের আগেই তাতাররা ক্রিমিয়া ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এখন পুরো ইউক্রেনে রাশিয়া সামরিক অভিযান চালালে তাতারদের আবারও উদ্বাস্তু হতে হবে।
ইউক্রেনে প্রায় চার লাখ মুসলিমের বসবাস। তাঁদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্রিমিয়ার তাতাররা। ইউক্রেনে মুসলিমদের ধর্মীয় প্রশাসন ‘উম্মায়’ কর্মরত রয়েছেন কামিলা ইয়োশেঙ্কো। তাঁর মতে, ইউক্রেনের বহুজাতিক সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ মুসলিমরা। তবে অতীতের মতোই রুশ আগ্রাসনে তাঁদের বেশি ভুগতে হতে পারে। বিশেষত ক্রিমিয়ান তাতারদের।
কামিলা ইয়োশেঙ্কো বলেন, ‘তাতারসহ ইউক্রেনের মুসলিমদের, সর্বোপরি ইউক্রেনবাসীর ভাগ্য এখন অনেকটাই ঝুলে রয়েছে চলমান সংকট নিরসনে চলা বিশ্বনেতাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ওপর। ইউক্রেন আমাদের জন্মভূমি। এখানে কী ঘটতে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত চিন্তা করি। আমাদের ভাগ্যে কী পরিণতি লেখা রয়েছে, সেটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন থাকি।’
আল জাজিরা ও রয়টার্স থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন অনিন্দ্য সাইমুম ইমন