উড়নচণ্ডীকেও এখানে ছেড়ে দিলে বই পড়বে
সময়ের ব্যবধানে দিন-রাত গুলিয়ে গেছে। রাত তিনটায় ঘুম ভেঙে যাচ্ছে, আর ঘুম আসছে না। গত দিন যেমন মুশকিল আসান হয়ে এসেছিল ফাতেমা-তুজ-জোহরা, আজ সে জায়গাটা নিল আরিফিন সন্ধি। সকালে হোটেলের রেস্তোরাঁয় নাশতা করে ঘরে এসে যখন লিখছি, তখন ফোনের মেসেঞ্জারে সন্ধি উপস্থিত, ‘জাহীদ ভাই, আমি প্রথম আলোর সন্ধি। এখন সুইডেনের স্টকহোমে পিএইচডি করছি, অবসর পেলে জানাবেন। আপনার সঙ্গে দেখা করব।’
জানা গেল, স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়েই ও পড়ে। দেশ ছেড়েছিল সেই ২০০৯ সালে। স্নাতকোত্তর করে এখন পিএইচডি করছে। পড়ালেখা শেষ হবে এই ফেব্রুয়ারিতেই। প্রথম আলোর বিজ্ঞান ও কম্পিউটার পাতার তুখোড় প্রদায়ক ছিল। এখনো প্রথম আলোর কারও সঙ্গে দেখা হলে হৃদয় মেলে দেয়।
বললাম, ‘আমি তো এখন তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসব।’
সন্ধি বাতলে দিল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথ। গত দিন ফাতেমাও বলে দিয়েছিল। গ্যামলা স্তানে গিয়ে মেট্রো বদল করে ৪টা স্টেশন পার হলেই বিশ্ববিদ্যালয়।
সন্ধি বলে রাখল, আজ ও লাঞ্চ করাবে। কী করে যেন বুঝে গেছে, এখন পর্যন্ত আমার দৌড় ম্যাকডোনাল্ডস আর টার্কিশ খাবার।
স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়
৮ ডিসেম্বর সকালে নোবেল বিজয়ীরা (পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও অর্থনীতি) ওখানকার আউলা মাগনায় বক্তৃতা করবেন। রাস্তাঘাট কম চিনি বলে আজ সকালে ‘রেকি’ করার জন্য ওখানেই যাব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম। সন্ধির সঙ্গে কথা হওয়ায় তা হলো সোনায় সোহাগা।
এরই মধ্যে পথ চিনে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমার শিশুকাল কেটে গেছে। এখন কোন পথে কোন বাস বা মেট্রো ধরে কোথায় যেতে হবে, তা শুনলেই সহজে বেরিয়ে পড়তে পারি। তাই এবার আর অসুবিধা হলো না। গ্যামলা স্তানে মেট্রোর লাইন পরিবর্তন করে সমান্তরাল আরেকটি রুটে কয়েক স্টপেজ পার হতেই স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন। মাটির অনেক গভীরে এই স্টেশন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হলে এসকালেটরে করে উঠতে হয় অনেক উঁচুতে। সেখানেই দেখা হয়ে যায় সন্ধির সঙ্গে। একেবারে পাগল ছেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাড়ি-নক্ষত্র না জানিয়ে ছাড়বে না। একেক ভবনে নিয়ে যায় আর কথার তুবড়ি ছোটায়। সত্যি বলি, একেক ভবনের সৌন্দর্য একেক রকম। যেমন খোলামেলা, তেমনি যেকোনো জায়গায় বসে পড়াশোনা করে নেওয়া যেতে পারে। ক্যাফেটেরিয়া আছে, সেখানে বসে খাওয়া যায়। আবার লাইন টানা বেঞ্চিতে পড়তে পড়তেও খাওয়া যায়।
ওদের প্রধান খাবার আলু। আলু ছাড়া খাদ্য—ভাবতেই পারে না ওরা। সন্ধি একটা দারুণ গল্প বলল। সুইডেনের দুই শিক্ষার্থী গিয়েছিল ঢাকার চাঁদপুরে। কাজে। সন্ধির কাছে অবাক হওয়া ওদের প্রশ্ন: ‘তোমাদের দেশের মানুষ ভাতও খায়, আলুও খায়! এটা কী করে সম্ভব?’
মানে আলুভর্তা ভাতের সঙ্গে মেখে খাচ্ছে কেউ—এ দৃশ্য সুইডিশ নাগরিকের জন্য অবাক কাণ্ডই বটে! আলুই তো ওদের ভাত! তাই ভাত দিয়ে ভাত কী করে খাওয়া যায়, এ প্রশ্ন ওদের মনে জাগতেই পারে।
দেখার মতো হলো পাঠাগার। পড়াশোনা করতে না চাওয়া উড়নচণ্ডীকেও এখানে এনে ছেড়ে দিলে বই পড়ার লোভ হবে ওর। এত বড় আর এত রকম ধরনের পড়ার সুযোগ যে পড়তে বসতে হবেই। একতলায় সাধারণ পড়ার চেয়ার-টেবিলের পাশে আছে কাচে ঘেরা একটি ঘর। এই ঘরে ঢুকতে হয় মোবাইলসহ যন্ত্রপাতি বাইরে রেখে। এখানে শুধু নিবিষ্ট মনে পড়ালেখা করতে হয়। কোনো কথা বলা যাবে না। শুধু পড়া আর পড়া।
পাঠাগারে আছে কয়েকটা আলাদা ঘর, যেগুলো বুক করতে হয় গ্রুপ স্টাডির জন্য। এখানে কেউ এসে ঝামেলা পাকাবে না। পড়াশোনা ঠিকভাবে বুঝে নিয়ে তবেই মুক্তি। বই জমা দেওয়ার একটি পদ্ধতি বেশ ভালো লাগল। কম্পিউটারাইজড সিস্টেম। বই নির্দিষ্ট স্থানে রেখে কম্পিউটারের মনিটরে বইয়ের নাম, কবে নেওয়া হয়েছিল ইত্যাদি লিখে স্বয়ংক্রিয় মেশিনে দিয়ে দিলেই তা বুঝে নেবে পাঠাগার কর্তৃপক্ষ। বই দিতে বিলম্ব হলে হয় জরিমানা। সে জরিমানার ভয়ে প্রায় সবাই আগেভাগেই জমা দিয়ে দেয় বই।
ক্যাফেটেরিয়ায় ‘কী খাবেন?’
‘সুইডিশ খাবার।’
‘ঠিক। সুইডিশ খাবারই ভালো হবে’ বলে মেন্যু দেখতে থাকে সন্ধি। দুটো খাবার আমাদের পছন্দ হয়, একটি হলো টার্কির মাংস, অন্যটি সামুদ্রিক মাছ। আমরা সামুদ্রিক মাছটাই বেছে নিই।
প্লেটে একটা ভাজা মাছ, চারটি গোল আলু, খানিকটা মায়োনিজ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো আমাদের। সে খাবার টেবিলে রেখে আমরা ছুটি সালাদের সন্ধানে। কত রকম সালাদ যে আছে এখানে! রিসাইক্লিং করা কাগজের প্লেটে আমরা সালাদ নিই। এখানে আছে বাঁধাকপির টক সালাদ, গাজর, বিনস, অলিভসহ নানা সালাদ। আর আছে বিস্কুটের মতো শক্ত কিছু রুটি। মাখন লাগিয়ে তা খেতে হয়।
মোটেই খারাপ লাগল না খেতে। সুইডিশ খাবার মন্দ নয়। যদিও পরপর কয়েক দিন এ খাবার খাওয়া একটু কষ্টকর হয়ে যাবে। তাই স্বাদবদলও জরুরি।
এখানে আমরা কফি খেলাম না। খেলাম সন্ধির অফিসে। স্বয়ংক্রিয় মেশিনে নিজেরাই কাপুচিনো কফি বানিয়ে আয়েশ করে চুমুক দিয়ে নিশ্বাস ছাড়ি—আহ!