ইউরোপযাত্রায় ডুবে মারা যায় শিশু ছেলে, এখন বাবাই বিচারের মুখোমুখি
গ্রিসে আশ্রয়প্রার্থী ২৬ বছরের এক আফগান বিচারের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন। তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচ বছর বয়সী ছেলের জীবন বিপন্ন করার অভিযোগ। ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর বাবার সঙ্গে তুরস্ক থেকে গ্রিসে যেতে গিয়ে নৌকা ডুবে মারা যায় শিশুটি। পরদিন দূরে তার লাশ পাওয়া যায়।
হাফেজ (ছদ্মনাম) নামের ওই আফগানের সঙ্গে কথা বলেছে আল–জাজিরা। বুধবার বিচারের মুখোমুখি হবেন তিনি।
ছেলের মৃত্যুর সেই দুর্ভাগ্যজনক যাত্রার কথা বলতে শুরু করলে ধীরে ধীরে গলাটা ধরে আসে হাফেজের। সেদিন ছেলেকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ভাগ্য উন্নয়নের আশায় নৌকায় চড়ে বসেছিলেন হাফেজ। মোট যাত্রী ছিলেন ২৪ জন। ইজিয়ান সাগরে গ্রিসের সামোস দ্বীপে পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নৌকাটি ডুবে গিয়েছিল। হাফেজের বুক থেকে ছিটকে পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল তাঁর সন্তান। পরে গ্রিস কর্তৃপক্ষ তাকে কেপ প্রাসোর তীরে একটি খাড়া পাথুরে অংশে খুঁজে পায়। এই এলাকাকে ‘কেপ অব ডেথ’ বলা হয়।
হাফেজ বলেন, সন্তানের উন্নত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে লাখ লাখ মানুষের মতো তিনিও ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। তুরস্কে আশ্রয় চেয়ে তাঁর করা আবেদন দুই দফায় প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। তাঁকে আফগানিস্তানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তুরস্ক কর্তৃপক্ষ।
হাফেজ বলেন, ‘আমি আমার সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এখানে এসেছি।’ স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ছেলে যে তাঁর কাছে কতবার জানতে চেয়েছে, কখন সে আবার স্কুলে যেতে পারবে। তিনি বুঝতে পারছেন না, তাঁর জীবনে এত বড় দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও কেন তাঁকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে আসা এই বাবা বলেন, ‘শুধু আমি নই। এমন অনেকে আছেন, যাঁরা গ্রিসে আসার পথে তাঁদের পরিবার, সন্তান, স্ত্রীকে হারিয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘তাঁরা কী প্রমাণ করবে? আমাদের সঙ্গে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা–ই?’
আয়লান কুর্দি
নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টায় ইজিয়ান সাগরে ডুবে হাফেজের সন্তানের মতো আরও অনেক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ২০১৫ সালে দুনিয়াব্যাপী সাড়া ফেলেছিল দুই বছরের আয়লান কুর্দির মৃত্যুর ঘটনা। তুরস্ক থেকে গ্রিসে যাওয়ার পথে নৌকা ডুবে নিখোঁজ হয় সে। পরে তুরস্কের সৈকতে তার লাশ ভেসে আসে।
তখন যুদ্ধকবলিত সিরিয়া থেকে ১০ লাখের বেশি মানুষ আশ্রয়ের জন্য ইউরোপে যাওয়ায় যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল, তার প্রতীক হয়ে উঠেছিল আয়লান কুর্দি।
গ্রিসে হাফেজের আইনজীবী দিমিত্রিস চৌলিস বলেন, জানামতে, জাহাজের ধ্বংসাবশেষে কোনো আশ্রয়প্রার্থীর সন্তানের মৃত্যুর জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলার ঘটনা হাফেজেরটিই প্রথম। দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
চৌলিস আল-জাজিরাকে বলেন, তিনি মনে করেন, তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন। এই আইনজীবী বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হবেন।’ চৌলিস বলেন, উল্টো এ ঘটনায় কর্তৃপক্ষের তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ওই রাতে উদ্ধার অভিযান চালাতে কর্তৃপক্ষের ছয় ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছিল।
নরওয়ের একটি বেসরকারি সংস্থা ইজিয়ান বোট রিপোর্ট আল-জাজিরাকে জানিয়েছে, ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর রাত ১২টা ৬ মিনিটে তারা সামোস বন্দর পুলিশকে এ দুর্ঘটনার খবর জানিয়ে ফোন দেয়। ইজিয়ান বোট রিপোর্ট গ্রিসে আশ্রয়প্রার্থীদের আগমন পর্যবেক্ষণ করে থাকে।
চৌলিসের তথ্যমতে, পাথরে ধাক্কা খেয়ে নৌকা থেকে ছিটকে পড়া লোকজন সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাঁরা সেখানে একটি নৌযানকে টহল দিতে দেখেছিলেন। সেটি থেকে তাঁদের ওপর আলোও ফেলা হয়েছে কিন্তু তাঁদের দেখেও নৌকাটি চলে গিয়েছিল।
গ্রিক কোস্টগার্ড সে সময় গণমাধ্যমকে বলেছিল, তারা ফোনে একটি দুর্ঘটনার খবর পেয়ে প্রাথমিকভাবে সাড়া দিয়েছিল কিন্তু কাউকে খুঁজে পায়নি।
হন্যে হয়ে ছেলেকে খুঁজতে থাকা হাফেজের সঙ্গে সকাল ছয়টায় পুলিশের দেখা হয়। ঘটনা সম্পর্কে পুলিশকে সবকিছু খুলে বলেছিলেন তিনি। সেই সকালে যখন তাঁর ছেলেকে পাওয়া যায়, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। সে আর এই পৃথিবীতে ছিল না। শিশুটি পড়ে ছিল অচেতন এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর পাশে। কয়েক দিন পরে সেই দ্বীপের হাসপাতালে সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন ওই নারী।
চৌলিস সেদিনের ঘটনার স্মরণ করে বলেন, হাফেজকে তখন তাঁর ছেলের লাশ শনাক্ত করার জন্য হাতকড়া পরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। হাফেজ যখন সন্তানের মরদেহ দেখতে গিয়েছিলেন, বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন চৌলিস। সেদিন হাফেজ বড় অসহায় ছিলেন। হাফেজ যখন সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন তাঁর হাতে হাতকড়া ছিল না। হাঁটতে পারছিলেন না বলে পুলিশ কর্মকর্তারা তাঁকে সহযোগিতা করছিলেন।
নৌকার মাঝিরও বিচার হবে
ওই নৌকার মাঝি হাসানও (ছদ্মনাম) একই দিনে বিচারের মুখোমুখি হবেন। তিনিও আফগান নাগরিক। পাঁচ বছরের শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর যাবজ্জীবন হতে পারে। আর নিজেকে বাদ দিয়ে ২৩ জনের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলায় তাঁর ২৩০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
আশ্রয়প্রার্থী অভিবাসীদের বহনকারী নৌকা চালানোর অভিযোগে গ্রিসে হাসানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। দেশটিতে এ ধরনের মামলা দিন দিন বাড়ছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলে আসছে, অভিবাসনকে অপরাধ হিসেবে দেখানোর প্রবণতা বাড়ছে। হাসান বলেন, পাচারকারীদের চাপে পড়ে নৌকার হাল না ধরে তাঁর উপায় ছিল না।
যুক্তরাজ্যের ইউনির্ভাসিটি অব লিভারপুলের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক জেম্মা বার্ড বলেন, যাঁরা যুদ্ধ ও নিপীড়নের হাত থেকে নিরাপত্তা চাইছেন, তাঁদের রাষ্ট্রীয় অপরাধী করার প্রবণতার অংশ হলো এই বিচার। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রিস ও ইতালিতে এ ধরনের ঘটনা দেখা গেছে। পাশাপাশি ইউরোপজুড়ে আশ্রয়প্রার্থীদের ঠেকাতে স্থল ও জল সীমান্তে কঠোর অবস্থান দেখা গেছে, যা বারবার মানুষকে জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
৫ মে গ্রিসে ‘অননুমোদিত প্রবেশের’ দায়ে সিরিয়া থেকে আসা তিন আশ্রয়প্রার্থী দোষী সাব্যস্ত হন। তাঁদের সব মিলিয়ে ৪৩৯ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁরা ২০২১ সালের ডিসেম্বরে নৌকায় করে এসেছিলেন। কিন্তু পারোস দ্বীপে নৌকাটি ডুবে গিয়েছিল।
‘কঠোর, তবে ন্যায়পরায়ণ’
গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিৎসোটাকিস অভিবাসীদের বিষয়ে তাঁর দেশের অবস্থানের পক্ষে সাফাই গেয়ে চলেছেন। পাশাপাশি সীমান্ত থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের অবৈধভাবে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছেন এবং কর্তৃপক্ষকে আইন মেনে চলার ওপর জোর দিয়েছেন।
মিৎসোটাকিস বলেন, দেশটির ‘কঠোর, তবে ন্যায়পরায়ণ’ অভিবাসননীতি রয়েছে, যেখানে মানবাধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
হাফেজের মামলা সম্পর্কে গ্রিসের অভিবাসনবিষয়ক মন্ত্রী নোতিস মিতারাচি সেই সময়ে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, যেকোনো মৃত্যুর ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘যদি কোনো মানুষের প্রাণহানি হয়ে থাকে, তাহলে সে ক্ষেত্রে কারও অবহেলা বা ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা উচিত।’ তিনি বলেন, সমুদ্রে যাত্রার জন্য যাঁরা নৌকায় ওঠেন ও অনভিজ্ঞ যাঁরা নৌকা চালান, তাঁরা অবশ্যই নিজেদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলেন।
হাফেজ বলেন, ‘আমার সঙ্গে যা হয়েছে, ভুলে যেতে চাই কিন্তু পারছি না।’
হাফেজ সামোসে বিচারের মুখোমুখি হবেন, যে দ্বীপে তাঁর ছেলেকে অন্য অনেকের সঙ্গে দাফন করা হয়েছে, যাঁরা গ্রিসে আশ্রয় পেতে গিয়ে মারা গেছেন। হাফেজ বললেন, ‘আমি ভেবেছিলাম গ্রিস হয়তো আমার ছেলের জন্য নিরাপদ হবে, হয়তো আমি এখানে আমার ছেলের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারব। কিন্তু তাকে হারানোর পর থেকে আমি আর আমি নেই।’