ইউক্রেনে পুতিন-বাইডেন কি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছেন
বিশ্ববাসীর চোখ এখন ইউরোপের পূর্ব সীমান্তে। সেখানে ইউক্রেনকে ঘিরে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। যেকোনো সময় পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক এ দুই পরাশক্তি যুদ্ধে জড়াতে পারে। পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও হুঁশিয়ারিতে কাটছে একেকটি দিন। উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। তবে কি ২০২২ সালে আরেকটি বড় যুদ্ধ দেখবে বিশ্ববাসী? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনে।
উত্তর খুঁজতে কিছুটা পেছনে তাকাতে পারি। ওয়াশিংটনে তখন চলছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসন। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রুশ-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সামাল দিতে গলদঘর্ম ট্রাম্প। তারপরও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি তাঁর মুগ্ধতা বিশ্ববাসীর নজর এড়ায়নি। একই সময় তিনি ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব তৈরি করেন। পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর ভূমিকা ও অর্থায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলে এ জোটের কার্যক্রমকে কার্যত দুর্বল করে তোলেন। এ সুযোগ লুফে নেন পুতিন।
ইউক্রেন পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল রূপ নিয়েছে, নিচ্ছে। মার্কিন গোয়েন্দাদের মতে, রুশ হামলা শুরু হলে কয়েক দিনের মধ্যেই ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের পতন ঘটবে। দেশটিতে ৫০ হাজার বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হতে পারে। শরণার্থী হবে বহু মানুষ।
রাশিয়ার ঘরের পাশের ইউক্রেন হলো সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র। ইউক্রেনে রাশিয়ার বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর বিপুলসংখ্যক মানুষের বসবাস। দুই দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনও বেশ নিবিড়। অন্যদিকে, ইউক্রেন ন্যাটোর ‘সহযোগী’ দেশ। এর অর্থ হলো, ভবিষ্যতে ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যুক্ত করার সুযোগ রয়েছে। এতেই নাখোশ পুতিন। ইউক্রেন যাতে ন্যাটোয় যোগ দিতে না পারে, সে ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে নিশ্চয়তা চান তিনি। পশ্চিমা বিশ্ব সে আশ্বাস দিতে নারাজ।
মস্কোর অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর মিত্ররা ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করছে। যৌথ মহড়া চালাচ্ছে। ন্যাটো ইউক্রেনে সামরিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করতে পারে। ভবিষ্যতে ইউক্রেন ন্যাটোয় যোগ না দিলেও এ জোট ওই অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখার সুযোগ পাবে, যা রাশিয়ার জন্য হুমকি। ঘরের পাশে শত্রুসেনার উপস্থিতি কে দেখতে চায়!
২০১৪ সালে ইউক্রেনের অংশ ক্রিমিয়া দখল করে নেন পুতিন। ওই সময় যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি পশ্চিমারা। এতে পুতিনের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। এদিকে ওয়াশিংটনের গদি থেকে বিদায় নেন ট্রাম্প। ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি ক্ষমতায় বসেন বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এরপর তিনি মিত্রদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা ফেরাতে বেশি মনোযোগ দেন। এই ফাঁকে ইউক্রেন সীমান্তে রুশ সেনাদের জমায়েত করতে শুরু করেন পুতিন।
আমরা এই আতঙ্ক চাই না। কারও মুখের কথায় ভরসা রাখতেও চাই না। আমরা চাই সংকট সমাধানে প্রত্যেক রাজনীতিক কার্যকর উদ্যোগ নিতে স্বচ্ছ থাকবেন।ভলোদিমির জেলেনস্কি, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট
গত এক বছরে পুরোনো ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে টানা, জলবায়ু ইস্যু এবং আফগানিস্তান নিয়ে বাইডেন যতটা মনোযোগ দিয়েছেন, ততটা হয়তো ইউক্রেনের দিকে দিতে পারেননি। তাই তো গত বছরের মার্চে ইউক্রেন সীমান্তে ১০ হাজারের মতো রুশ সেনা ছিল। এখন সেটা লাখ ছাড়িয়েছে। এর মাঝে হুমকি-ধমকি দেওয়া ছাড়া কার্যত কোনো পাল্টা পদক্ষেপ নেননি বাইডেন।
এখন ইউক্রেন পরিস্থিতি জটিল রূপ নিয়েছে। পশ্চিমাদের অভিযোগ, ইউক্রেনে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে চান পুতিন। তাই তিনি সীমান্তে সেনা জড়ো করেছেন। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গত রোববার হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেন, রাশিয়া কয়েক দিন বা সপ্তাহের মধ্যেই ইউক্রেনে হামলা করতে পারে। আর মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্য, পুরোদমে যুদ্ধ শুরু করতে ৭০ শতাংশ প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে রাশিয়া।
পিছিয়ে নেই পশ্চিমারা। ন্যাটো বাহিনীকে জোরদার করতে রোমানিয়া ও পোল্যান্ডে অতিরিক্ত সেনা পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেনা পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্ররাও। এ কারণে ইউক্রেন পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল রূপ নিয়েছে, নিচ্ছে। মার্কিন গোয়েন্দাদের মতে, রুশ হামলা শুরু হলে কয়েক দিনের মধ্যেই ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের পতন ঘটবে। দেশটিতে ৫০ হাজার বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হতে পারে। শরণার্থী হবে বহু মানুষ।
এখন প্রশ্ন হলো, সত্যি কি যুদ্ধ বাধবে? নাকি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চলবে? উত্তরটা আপাতত অজানা। জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের জ্যেষ্ঠ ফেলো স্লাভমির সিয়েরাকভস্কির মতে, পুতিন চাইবেন যুদ্ধে জড়াতে। কেননা তিনি জানেন, জমায়েত করা লাখখানেক সেনাকে ফিরিয়ে নিলে পশ্চিমারা আর রাশিয়াকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে না। ন্যাটো পূর্ব ইউরোপে তার উপস্থিতি জোরদার করা শুরু করবে। আর ঘরের পাশের ইউক্রেন আগেই পুতিনের নিয়ন্ত্রণ থেকে দূরে সরে গেছে, এটা তিনিও বোঝেন।
ভিন্নমত পোষণ করে ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টার রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের ইতিহাসবিষয়ক অধ্যাপক ডেভিড মারলেস বলেন, পুতিন পুরোপুরি পাগল হয়ে না গেলে ইউক্রেনে যুদ্ধে জড়াবেন না। কেননা, চীন পাশে থাকলেও এ যুদ্ধের অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক চাপ সামলানো রাশিয়ার পক্ষে সম্ভব নয়। পুতিন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজের ও রাশিয়ার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে এ খেলায় মেতেছেন।
তবে ইউক্রেন ইস্যুতে এখন পর্যন্ত পুতিনের ভূমিকা বেশ আগ্রাসী। মহড়ার জন্য কৃষ্ণসাগরে ছয়টি রুশ যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে, সদ্য আফগান যুদ্ধ থেকে বের হয়ে আসা বাইডেন হয়তো এখনই নতুন করে আরেকটি যুদ্ধে জড়াতে চাইবেন না। ইউরোপের দেশগুলোও নিজেদের মহাদেশে উত্তেজনা চাইবে না। কেননা, ইউক্রেনে যুদ্ধ বাধলে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে শরণার্থীদের চাপ সামলাতে হবে। করোনা মহামারির মধ্যে পশ্চিমাদের ভঙ্গুর অর্থনীতি বাড়তি এ চাপ সামলাতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক।
তাই তো সবদিক বিবেচনা করে সংকট নিরসনে আপাতত সমরনীতির পরিবর্তে কূটনীতিকে প্রাধান্য দিতে শুরু করেছেন বাইডেন। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা এর প্রমাণ। আলোচনার পথ উন্মুক্ত করতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সম্প্রতি কিয়েভ সফর করেছেন। সর্বশেষ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ মস্কো ও কিয়েভ সফরে যান। বৈঠক করেন পুতিনের সঙ্গে। এ সময় মাখোঁ দাবি করেন, ইউক্রেনে সংকট যাতে আর না বাড়ে, সে ব্যাপারে পুতিনকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। সেনা ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন পুতিন। তবে পুতিন এ দাবি অস্বীকার করেছেন। মস্কোয় মাখোঁ যখন পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন, তখন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস যুক্তরাষ্ট্র সফর করে বাইডেনের সঙ্গে এ ইস্যুতে বৈঠক করেন।
গত রোববার জ্যাক সুলিভান হোয়াইট হাউস থেকে রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানান, ইউক্রেন সংকট সমাধানে রাশিয়া এখনো কূটনৈতিক পথ বেছে নিতে পারে। আলোচনার জন্য একদিকে ইউরোপীয় নেতাদের দৌড়ঝাঁপ, অন্যদিকে হোয়াইট হাউসের নমনীয় মনোভাব ইউক্রেন ইস্যুতে বাইডেনের রক্ষণাত্মক কৌশলের ইঙ্গিত দেয়।
এ বিষয়ে সাবেক মার্কিন কূটনীতিক ড্যানিয়েল ফ্রাইড বিবিসিকে বলেন, ইউক্রেন বাইডেনের সামনে বড় একটি পরীক্ষা। প্রেসিডেন্ট বাইডেন জানেন, তিনি রাশিয়াকে কীভাবে মোকাবিলা করেন, সেদিকে চীন গভীরভাবে নজর রাখছে। চাপের মুখে চীন ও রাশিয়া এখন অনেকটাই কাছাকাছি এসেছে। গত সপ্তাহে পুতিনের বেইজিং সফর এবং পুতিন ও সি চিন পিংয়ের একসঙ্গে তোলা ছবিই এর প্রমাণ। তাই এ আদর্শিক লড়াইয়ে বাইডেনকে জিততে হবে এবং সেটা যতটা সম্ভব যুদ্ধে না জড়িয়ে।
আগামী কয়েকটা সপ্তাহ ইউক্রেনের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার চলমান যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা কোন দিকে মোড় নেয়, এ সময় সেটা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির কথায় সমঝোতার আভাস দেখা গেছে। কিয়েভে মাখোঁর সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা এ আতঙ্ক চাই না। কারও মুখের কথায় ভরসা রাখতেও চাই না। আমরা চাই সংকট সমাধানে প্রত্যেক রাজনীতিক কার্যকর উদ্যোগ নিতে স্বচ্ছ থাকবেন।’ এখন দেখার বিষয় জেলেনস্কির এ আশা বাস্তব হয় কি না।