২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

আইএস জঙ্গিকে বিয়ে ও সিরিয়া ঘুরে ফেরা এক তরুণীর গল্প

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ তানিয়া জয়া। নিজের পছন্দে বিয়ে করেন মার্কিন যুবক জন জর্গেলাসকে। সংসার শুরুর পর তানিয়া জানতে পারেন, জন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সদস্য। একপর্যায়ে জন তাঁকে ও সন্তানদের সিরিয়ায় নিয়ে যান। এরপর সিরিয়া থেকে তানিয়া তাঁর সন্তানদের নিয়ে আমেরিকায় ফেরেন। জন রয়ে যান সেখানেই। জীবনে ঘটে যাওয়া এসব অভিজ্ঞতার কথাই তানিয়া লিখেছেন ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান-এ

তানিয়া জয়া
ছবি: গার্ডিয়ানের সৌজন্যে

আমি ১৯৮৩ সালের দিকে উত্তর যুক্তরাজ্যের লন্ডনে জন্মগ্রহণ করি। আমার বেড়ে ওঠা একটি বাঙালি-বাংলাদেশি পরিবারে। আমি সব সময় পুরোপুরি ইংরেজদের মতো হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার পরিবারের লোকজন আমাকে চাপ প্রয়োগ করত। তারা চাইত আমি যেন ‘ভালো মুসলিম মেয়ে’ হই এবং পশ্চিমা সমাজের সঙ্গে বেশি মেলামেশা না করি। বলতে পারেন, আমার পারিবারিক জীবন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। মা-বাবার ওপর আস্থা রাখতে না পারলে আস্তে আস্তে সবকিছুর ওপর থেকেই আস্থা হারিয়ে ফেলে যে কেউ।

১৭ বছর বয়সে আমরা পূর্ব লন্ডনে চলে যাই। সেখানে আমার নতুন নতুন বন্ধু হয়। কিন্তু তারা সবাই অনেক বেশি রক্ষণশীল। আমার পশ্চিমা চালচলনের কারণে তারা আমাকে লজ্জা দিত। আমি তখন হতাশায় নিমজ্জিত হতে লাগলাম; আমি শুধু একজন নতুন মানুষ হতে চেয়েছিলাম। আমার এক কাজিন ছিল। আমার ওপর ওর প্রভাব ছিল অনেক। বিশ্ববিদ্যালয়ে সে মৌলবাদে জড়িয়ে পড়ে। সে আমাকে খেলাফতের ব্যাপারে শিক্ষা দেয়। আমি তখন অনলাইনে অনেক বেশি সৌদি আরবের ফতোয়া পড়তাম। আমি ভাবতাম, আমি শুধু সত্যের সন্ধান করছি।

ঘটনার শুরু ২০০৩ সালে। তখন ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে লন্ডনে এক মিছিলে অংশ নিয়েছিলাম। মিছিলের মধ্যেই কয়েকজন আমাকে মুসলিম ‘ডেটিং ওয়েবসাইটের’ ঠিকানা দিয়ে একটি কাগজ ধরিয়ে দেয়। সেখানেই আমি জন জর্গেলাসের দেখা পাই। জন মার্কিন নাগরিক ও ধর্মান্তরিত মুসলিম। সে মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছিল। দেখতে বেশ সুদর্শন ছিল। আর বহু ভাষায় পারদর্শী ছিল। আমি তাঁর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি।

জনের প্রথম লন্ডন ভ্রমণের সময়ই আমরা বিয়ে করি। ভেবেছিলাম বাড়ি ছাড়ার এটাই একমাত্র উপায়! এর কিছুদিন পর আমরা যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই। সেখানে আমাদের একটি ছেলেসন্তান হয়। আমি হিজাব ছেড়ে দিই। আস্তে আস্তে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছিলাম। জন তখন অনেক উগ্র হয়ে ওঠে। ২০০৬ সালে এক ইসরায়েলি ওয়েবসাইট হ্যাক করার অভিযোগে জন গ্রেপ্তার হয় এবং সে তিন বছরের জন্য কারাগারে যায়। আমি তখনো অর্থনৈতিকভাবে জনের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। আমি তখনো বুঝে উঠতে পারিনি যে আমি অস্বাভাবিক এক বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি।

জন জামিনে ছাড়া পেয়ে বের হওয়ার পর আমরা মিসর চলে যাই। এরপর আমাদের তিন সন্তানসহ আমরা ইস্তাম্বুলে গিয়ে থাকা শুরু করি। জন বারবার সিরিয়া যেতে চাইছিল। কিন্তু আমি কখনোই আমার সন্তানদের নিয়ে যুদ্ধ চলা এক অঞ্চলে গিয়ে থাকতে রাজি ছিলাম না। ইস্তাম্বুলে জীবনযাত্রার ব্যয় বহন করে থাকা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। জন তখন সন্তানদের নিয়ে আমাকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার কথা বলে। সে আমাদের সরাসরি সিরিয়া সীমান্তের দিকে না নিয়ে তুরস্কের এক জায়গায় নিয়ে যায়।

মধ্যরাতের দিকে আমরা যখন একটা বাসে চড়ে বসি, আমি বুঝতে পারছিলাম না কী ঘটছে। আমি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম। আমি তখন শুধু আমার সন্তানদের নিয়ে খানিকটা বসার জায়গা খুঁজছিলাম, যেন একটু ঘুমাতে পারি। সূর্যোদয়ের সময় আমরা সিরিয়ার চেকপয়েন্টে আটকা পড়ি। জন তখন কোনো রকমের ঝামেলা না করতে আমাকে হুঁশিয়ার করে।

আমি একটি ফোন জোগাড় করেই জনের মাকে ফোন করে সব বলি। তাঁকে জানাই জন আমাদের মিথ্যা বলেছে। আমি কান্নাকাটি শুরু করি এবং তাঁকে বলি জনকে যে এফবিআই সদস্য দীর্ঘদিন ধরে অনুসরণ করছে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। পরে এফবিআই আমাকে বলে, আমি যদি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসি, তাহলে আমার বিরুদ্ধে কোনো উগ্রবাদী দলে যোগ দেওয়ার অভিযোগ তোলা হবে না।

সিরিয়ায় থাকাকালে আমি আমার সন্তানদের হারানোর ভয়ে থাকতাম। এফবিআইকে জানানোর জন্য জন আমার ওপর বেশ ক্ষুব্ধ ছিল। ওর ওপর আমারও অনেক রাগ হয় আমাদের সঙ্গে এমন প্রতারণার কারণে। এসব নিয়ে আমাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। আমি মুখ ঢেকে চলা বন্ধ করে দিই। তার বন্ধুরা তাঁকে চাপ দিতে থাকে—হয় আমাকে ছেড়ে দিক, নাহয় আমাকে নিয়ন্ত্রণ করুক।

শেষ পর্যন্ত জনের কেন জানি দয়া হয়। সে আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। যদিও নানা রকমের ঝামেলার কারণে আমাকে তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আমাদের সীমান্ত পার করে দিতে জন এক মানব পাচারকারীকে টাকা দেয়। মাইলের পর মাইল হেঁটে-দৌড়ে, স্নাইপারের গুলি উপেক্ষা করে আমরা একটি ট্রাকে উঠি।

ওই মানব পাচারকারীর আমাদের বাসস্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে আমাদের জনমানবশূন্য এক জায়গায় ছেড়ে গায়েব হয়ে যায়। আমি উদভ্রান্তের মতো হয়ে যাই। তখন তুরস্কের এক পুরুষ আমাদের রাস্তা খুঁজে পেতে সাহায্য করে। বেঁচে থাকতে পেরে আমি কৃতজ্ঞ। আমি আমার সন্তানদের ভালো একটা জীবন দিতে চেয়েছি, তাদের স্বাভাবিক একটা জগতে নিয়ে যেতে চেয়েছি।

আইএসের হয়ে খেলাফত কায়েম করতে জন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। সে আইএসের নেতৃস্থানীয় প্রচারকারী ছিল। এরপর আমাদের আর কখনো দেখা হয়নি। পরে জানতে পারি, সিরিয়াতে জন আবার বিয়ে করেছিল। গত বছর আমি জানলাম, সে মারা গেছে। সম্ভবত ২০১৭ সালে মার্কিন বোমা হামলায় তাঁর মৃত্যু হয়।

এখন আমি টেক্সাসে আমার শ্বশুর-শাশুড়ির কাছাকাছি এক বাড়িতে থাকি। আমি জানি, এটা তাদের জন্য এবং আমার সন্তানদের জন্য ভালো। আমার বর্তমান স্বামী একজন ভদ্র মানুষ। আমি আপন সত্তায় স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে ভালোবাসি।