জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ সম্প্রতি নজিরবিহীন এক কাজ করেছে। তারা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দুই প্রভাবশালী স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়ার প্রতি মানবাধিকার প্রশ্নে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা। কোনো ধরনের ভয়ভীতি বা পক্ষপাত ছাড়া সর্বত্র মানবাধিকার সুরক্ষা করা, কোথাও এর ব্যত্যয় হলে নিন্দা জানানোসহ পদক্ষেপ নিয়ে থাকে সংস্থাটি।
মানবাধিকার পরিষদ এরই মধ্যে চমৎকার কিছু কাজ করেছে। ২০১১ সালে সিরিয়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত পরিষদের তদন্ত কমিশন বেশ খাটাখাটুনি করে প্রতিবছর কয়েকবার ফরেনসিক প্রতিবেদন তৈরি করেছে। মিয়ানমারে মানবাধিকার বিষয়ে গঠিত তদন্ত দল রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগের কথা বিস্তারিত তুলে ধরেছে। মিয়ানমারের ক্ষমতাধর জান্তা সরকারই যে এ জন্য দায়ী, তা সুস্পষ্টভাবে তারা তুলে ধরেছে।
অবশ্যই ছোট বা বড় কোনো দেশই পরিষদের বিরূপ পদক্ষেপের বাইরে থাকতে চায়। তাই সবাই তাদের নেতিবাচক পদক্ষেপ থেকে বাঁচার চেষ্টা করে। এতে কেউ সফল হয়, আবার কেউ হয় না। তবে চলতি সপ্তাহে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোকে হতাশ করে চীন সফল হয়েছে।
গত আগস্টে জাতিসংঘের বিদায়ী মানবাধিকার কমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত তাঁর মেয়াদের শেষ মুহূর্তে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। মানবাধিকারকর্মীরা যেমনটা অনুমান করেছিলেন, প্রতিবেদনে ঠিক তেমনই উইঘুরে নির্বিচারে আটক থেকে শুরু করে জোরপূর্বক শ্রম, নির্যাতন—মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপক প্রমাণ পাওয়ার কথা বলা হয়। প্রতিবেদনে একে মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়ে থাকতে পারে বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশের পর সাধারণত যৌক্তিক যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তা হলো মানবাধিকার পরিষদে এ নিয়ে বিতর্কের আয়োজন, সংশ্লিষ্ট দেশকে পর্যবেক্ষণের জন্য একজন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ বা একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব এই প্রতিবেদনকে বেশ হালকাভাবেই নিয়েছিল। তারা কেবল বিতর্ক আয়োজনের কথা বলে এবং এতে ভোটাভুটিতে তারা হেরে যায়।
চীন বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। তারা বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে চীনা বিনিয়োগে লাভবান আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে। চীনের রাষ্ট্রদূত মানবাধিকার পরিষদের এসব সদস্যকে বুঝিয়েছে যে বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ পশ্চিমাদের ‘রাজনৈতিক দৌরাত্ম্যে’ বিরক্ত। উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আজ আমাদের সঙ্গে হচ্ছে, কাল আপনারাও এর শিকার হতে পারেন।’
এরপর যখন মানবাধিকার পরিষদে ভোট গণনা হয় তখন দেখা গেল, প্রস্তাবের পক্ষ ১৭ ও বিপক্ষে ১৯ ভোট পড়েছে। আর ভোটদানে বিরত ছিল ১১টি দেশ। একমাত্র আফ্রিকান দেশ সোমালিয়া প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। আর মৌরিতানিয়া থেকে সেনেগাল, আইভির কোস্ট থেকে ক্যামেরুন—সবাই চীনকে সমর্থন করেছে।
এই ভোট দেখিয়ে দিয়েছে পরাশক্তি হিসেবে বিশ্বে চীনের অবস্থান কতটা জোরালো। দেশটি জাতিসংঘের ছোট সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে কতটা প্রভাবিত করতে সক্ষম, বিশেষ করে যারা অর্থনৈতিকভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল। তবে পরে যখন রাশিয়া প্রসঙ্গ আসে, তখন মানবাধিকার কী এবং কে মানবাধিকার রক্ষা করবে, তা নিয়ে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গভীর বিভাজন দেখা দেয়।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর থেকে মস্কোর কূটনীতিকেরা কোণঠাসা হতে থাকেন। অথচ এর আগে তাঁদের জেনেভায় জাতিসংঘের এক বৈঠক থেকে আরেক বৈঠকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। গত মার্চে রাশিয়াকে মানবাধিকার পরিষদ থেকে বাদ দেওয়া হয়। এখন তার ভূমিকা শুধু পর্যবেক্ষকের। চলতি সপ্তাহে যখন রাশিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার নিয়োগের প্রস্তাবটি ওঠে, তখন পশ্চিমা কূটনীতিক ও অধিকারকর্মীরা নিশ্চিত ছিলেন, এটি অনুমোদন পাবে।
রাশিয়ায় ভিন্নমতাবলম্বীদের গণগ্রেপ্তার, মারধর এবং স্বাধীন গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধের মাধ্যমে দমন-পীড়ন আরও নৃশংস হয়ে উঠেছে। এর মধ্যেও রাশিয়ান মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো সাহসিকতার সঙ্গে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে সহায়তার আশায় জাতিসংঘের দিকে তাকিয়ে আছে।
চীনের মতোই রাশিয়ার ওপরও মানবাধিকার-সংক্রান্ত প্রস্তাবটি নিয়ে বিতর্কের জন্য ভোটাভুটিতে যায় এবং এবার তা পাস হয়। এতে খুশি হয়ে পশ্চিমা কূটনীতিকদের একজন টুইট করে লিখেন, ‘৭০তম শুভ জন্মদিন, মি. পুতিন।’ কিন্তু ভোট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পশ্চিমাদের খুব বেশি খুশি হওয়ার কিছু নেই। মাত্র ১৭ সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে, ৬ সদস্য বিপক্ষে আর বিস্ময়ের বিষয় হলো, ২৪ সদস্য ভোটদানে বিরত ছিল।
ভারত, পাকিস্তান, মেক্সিকো, আর্মেনিয়া ও হন্ডুরাসের মতো যেসব দেশ বরাবরই ভোটদানে নিজেদের বিরত রেখেছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, এভাবে অভিযোগ তোলা গঠনমূলক নয়। তাদের কথা হলো, কাউকে দায়ী না করে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান। এসব দেশের পরামর্শ হলো, ‘সাধুগিরি’র নামে পশ্চিমাদের অযাচিত হস্তক্ষেপ উচিত নয়। সার্বভৌম দেশগুলোকে নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই মেটানোর সুযোগ দেওয়া উচিত।
মানবাধিকার পরিষদে বছরের পর বছর ধরে এসব বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলে আসছে। কিন্তু কখনোই এতটা খোলামেলা ছিল না। মানবাধিকারের বিষয়টি সর্বজনীন হওয়ার কথা। মানবাধিকার পরিষদ মানবাধিকারকে সমুন্নত, এগিয়ে নেওয়া ও রক্ষায় বদ্ধপরিকর। কোথাও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরা। সর্বজনীন মানবাধিকার সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে পরিষদের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর জাতীয় স্বার্থ ও ভূরাজনৈতিক বিভেদের ঊর্ধ্বে ওঠে একসঙ্গে কাজ করার কথা।
রাশিয়া, চীনসহ যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার শিকার হয়েছিল, তাদের তৈরি মানবাধিকারের এই ধারণা দিন দিন খামখেয়ালি বলে মনে হচ্ছে। ক্ষমতাধর দেশগুলো মানবাধিকার পরিষদের পদক্ষেপ এড়াতে তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে। আর কম শক্তিশালী দেশগুলো একত্র হয়ে যুক্তি দেখাবে, তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপের কোনো প্রয়োজন নেই। তবে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, হাজার হাজার মানুষ, যারা দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, শুধু তারা নয়, সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।