‘নরক থেকে পালানোর’ গল্প শোনালেন ইউক্রেনের সেনা, আবার যাওয়ার অপেক্ষা
দক্ষিণ ইউক্রেনের খেরসন অঞ্চলে নিপ্রো নদীর দুই তীর এখন দুই বাহিনীর দখলে। পশ্চিমে রয়েছেন ইউক্রেনের সেনারা, পূর্বে রাশিয়ার। নদীর তীরে রাশিয়ার দখল করা এলাকাগুলো মুক্ত করতে মরণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেন বাহিনী। তবে জনবল ও সমরাস্ত্রের ঘাটতির কারণে ভুগতে হচ্ছে তাঁদের।
রাশিয়ার দখলে থাকা এলাকাগুলো নিয়ন্ত্রণে নিতে ছয় মাস আগে পাল্টা হামলা শুরু করেছিল ইউক্রেন বাহিনী। এর অংশ হিসেবে নিপ্রোর পূর্ব তীরে শত্রুশিবিরের মধ্যে একটি গ্রামে ঘাঁটি গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছে তারা। কয়েক শ ইউক্রেনীয় সেনা নিপ্রো নদী পেরোতে সফলও হয়েছেন।
ওই সেনাদের একজনের সঙ্গে কথা হয়েছে বিবিসির। নিরাপত্তার খাতিরে তাঁর পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। রাশিয়ার অবিরাম হামলার মুখে নিপ্রোর পূর্ব তীরে তিনি বেশ কয়েক সপ্তাহ কাটিয়েছিলেন। বার্তা আদান–প্রদানের অ্যাপে সে সময়ের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন তিনি।
ইউক্রেনের ওই সেনাসদস্য বলেন, ‘নদী পার হওয়ার স্থানগুলোতে অবিরত হামলা চলছিল। বোমার আঘাতে চোখের সামনেই আমাদের একটি নৌকা সেনাদের নিয়ে পানিতে ডুবে গেল। তাঁরা চিরতরে নিপ্রো নদীতে হারিয়ে গেলেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘শত্রুশিবিরের মধ্যে ঘাঁটি গড়তে আপনার অনেক কিছু প্রয়োজন হবে। তাই নদী পার হওয়ার সময় আমরা জেনারেটর, জ্বালানি ও খাবারসহ সবকিছু সঙ্গে নিয়েছিলাম। তবে এই জিনিসগুলোর সরবরাহ নিয়ে কোনো পরিকল্পনাই ছিল না সামরিক কর্মকর্তাদের।’
ইউক্রেনের সেনারা ভেবেছিলেন, নদী পার হওয়ার পর সেখান থেকে শত্রুসেনারা পালিয়ে যাবেন। তারপর তাঁরা ধীরে–সুস্থে প্রয়োজনীয় সব জিনিস সেখানে নেবেন। তবে আদতে তেমনটা ঘটেনি। বিবিসিকে ওই সেনা বলেন, ‘আমাদের হাতে আটক হওয়া কয়েকজন রুশ সেনা জানিয়েছেন, তাঁরা আগে থেকেই আমাদের নদী পেরোনোর বিষয়টি জানতেন। তাই আমরা যখন পূর্ব তীরে নামলাম, তখন আমাদের কোথায় পাওয়া যাবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানত রুশ বাহিনী। তারা কামানের গোলা, মর্টার—সব কিছু নিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, আমরা বেঁচে ফিরতে পারব না।’
ইউক্রেনের সেনারা নিপ্রোর পূর্ব তীরে পৌঁছানোর ফলে সেখানে রুশ সেনার সংখ্যা বাড়াতে হয়েছে। জাপোরিঝঝিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে রুশ সেনাদের সেখানে আনা হয়েছে।
রাশিয়ার ওই হামলার পরও কয়েক শ ইউক্রেনীয় সেনা সেখানে টিকে থাকতে পেরেছিলেন। তাঁরা জঙ্গলে অবস্থান করা শুরু করেন। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী গতকাল রোববার জানিয়েছে, তারা নিপ্রোর পূর্ব তীরে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে। সেখান থেকে শত্রুদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। তবে বিবিসির সঙ্গে যে সেনাসদস্য কথা বলেছেন, তাঁর বক্তব্যে ফুটে উঠেছে যুদ্ধ ঘিরে ইউক্রেন সরকার ও সেনা কর্মকর্তাদের বিভক্তি।
গত নভেম্বরে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল ভ্যালেরি জালুঝনি একটি সাময়িকীতে বলেছিলেন, ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো আমরা প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছি, যা আমাদের অচলাবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।’ ওই বক্তব্যের জন্য তাঁকে তিরস্কার করেছিল ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের কার্যালয়। একই সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে অচলাবস্থা সৃষ্টির বিষয়টিও অস্বীকার করা হয়েছিল।
নিপ্রোর পূর্ব তীরে দিন কাটানোর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ইউক্রেনের ওই সেনা বলেন, ‘জঙ্গলের মধ্যে থাকার সময় প্রতিদিন আমাদের ওপর হামলা হতো। আমরা ফাঁদের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। রাস্তাঘাটে সর্বত্র মাইন পোঁতা। তবে রাশিয়া তো সব জায়গা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না, সেগুলোই আমরা ব্যবহার করি। তবে আকাশ থেকে রাশিয়ার ড্রোনগুলো সব সময় নজর রাখে। কোনো তৎপরতা চোখে পড়লেই হামলা চালানোর জন্য সেগুলো প্রস্তুত থাকে।’
প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সংকট নিয়ে এই সেনা বলেন, রুশ বাহিনী তাঁদের সরবরাহপথগুলোর ওপর সব সময় নজর রাখত। ফলে পণ্য সরবরাহ কঠিন হয়ে পড়ে। দেখা দেয় খাওয়ার পানির সংকট। এরপর আবার জমাট বাঁধা শীতকাল আসছে। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। কেউ জানে না নিপ্রোর পূর্ব তীরে আসলেই কোন লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। এখানে অবস্থান করা সেনাদের অনেকেই মনে করছেন ইউক্রেনের সামরিক কর্মকর্তারা তাঁদের পরিত্যাগ করেছেন।
ইউক্রেনের ওই সেনার ভাষায়, ‘আপনি হয়তো শুনে হাসবেন যে এমন অনেককে আমাদের নৌবাহিনীতে নেওয়া হয়েছে, যাঁরা সাঁতার কাটতেও জানেন না।’
তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে ইউক্রেনের সেনারা নিপ্রোর পূর্ব তীরে পৌঁছানোর ফলে সেখানে রুশ সেনার সংখ্যা বাড়াতে হয়েছে। জাপোরিঝঝিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে রুশ সেনাদের সেখানে আনা হয়েছে। এতে কিয়েভ মনে করছে, তা জাপোরিঝঝিয়ায় শিগগিরই বড় কোনো সফলতা পাবে।
তবে দীর্ঘদিন ধরে লড়তে গিয়ে তাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন ইউক্রেনের ওই সেনা। নিপ্রোর পূর্ব তীরে কয়েক ব্রিগেড সেনা পাঠানোর কথা ছিল। তবে এখন সেখানে যথেষ্ট সেনা নেই। তাঁদের মধ্যে অনেকেই তরুণ। মাত্র তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁরা এসেছেন। বিবিসিকে ওই সেনা বলেন, ‘এক বছর আগে আমি এটা বলিনি। তবে এখন দুঃখ নিয়েই বলছি, আমি ক্লান্ত।’
ইউক্রেনের ওই সেনার ভাষায়, ‘যুদ্ধে যাঁরা স্বেচ্ছাসেবী সেনা, তাঁরা অনেক আগে বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। এখন মানুষকে অর্থের লোভ দেখিয়ে বাহিনীতে নেওয়া অনেক কঠিন। আর আপনি হয়তো শুনে হাসবেন যে এমন অনেককে আমাদের নৌবাহিনীতে নেওয়া হয়েছে, যাঁরা সাঁতার কাটতেও জানেন না।’
এক মাইন বিস্ফোরণে আহত হওয়ার পর নিপ্রোর পূর্ব তীর থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল ওই সেনাকে। ওই সেনা বলেন, ‘আমার মনে হয়, আমি নরক থেকে পালিয়ে এসেছি। তবে আমাদের জায়গায় যেসব সেনাকে সেখানে নেওয়া হয়েছে, তাঁরা এখন আরও নারকীয় পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন। কথা হলো, পূর্ব তীরে সেনাদের এই রদবদল চলতে থাকবে। আর খুব শিগগির হয়তো আমাকে আবার নদী পেরোতে হবে।’