মারিউপোলে যা যা দেখলেন পুতিন
যুদ্ধবিধ্বস্ত নগরীতে রাতে গাড়ি চালিয়ে ইউক্রেনের মারিউপোল শহর প্রথম সফর করলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। যুদ্ধের প্রথম দিকে রুশ বাহিনী যখন এ বন্দরনগরী ঘিরে রেখেছিল, সে সময় দুই পক্ষের লড়াইয়ে বিধ্বস্ত হয়েছিল শহরটি।
পুতিন মারিউপোলের যে পথ দিয়ে গেছেন, তার একটি অংশ চিহ্নিত করেছে বিবিসি। তাঁর এ যাত্রাপথের বেশ কয়েকটি জায়গা ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়েছিল। কয়েক মাসের লড়াই শেষে গত বছর মে মাসে শহরটি দখলে নেয় রুশ বাহিনী।
রাশিয়ার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, সিটি কনসার্ট হলের দিকে যাওয়ার সময় পুতিন তাঁর এক সঙ্গীর সঙ্গে গল্প করছেন। ক্রেমলিন বলেছে, গত শনিবার রাতে এ সফর করেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে শহরটি ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
মারিউপোলের নির্বাসিত ইউক্রেনিয়ান মেয়র ভাডিম বয়চেঙ্কো বিবিসিকে বলেছেন, মারিউপোল পুতিনের কাছে বিশেষ আগ্রহের। কারণ, এখানে যা ঘটেছে, সেটাই শহরটিকে তাঁর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের বুঝতে হবে যে মারিউপোল পুতিনের জন্য একটি প্রতীকী স্থান। এখানকার মতো অন্য কোনো শহর বিধ্বস্ত হয়নি। অন্য কোনো শহরই এত বেশি দিন অবরুদ্ধ ছিল না। অন্য কোনো শহরে এত বেশি বোমা বর্ষণ করা হয়নি। তিনি এখানে নিজে এসেছেন, তিনি কী করেছেন, সেটা দেখতে।’
রুশ হামলার স্থান দিয়ে গাড়ি চালিয়ে গেছেন
রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার পথের গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থান চিহ্নিত করেছে বিবিসি। পুতিন কুপরিনা স্ট্রিট দিয়ে গাড়ি চালিয়ে গেছেন মাইরু অ্যাভিনিউয়ে। তারপর গেছেন মেতালারহিভ অ্যাভিনিউয়ে, যেখানে রয়েছে ফিলহারমোনিক কনসার্ট হল। প্রকাশিত ফুটেজে পরে তাঁকে ওই হল পরিদর্শন করতে দেখা গেছে।
গাড়িতে পুতিনকে দেখা গেছে কালো টুপি পরা এক ব্যক্তির সামনে বসে থাকতে। রুশ গণমাধ্যম বলছে, ওই ব্যক্তি রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী মারাত খুসনুলিন।
মাইরু অ্যাভিনিউ দিয়ে যাওয়ার সময় বাঁ পাশে পাখির ভাস্কর্য দেখা গেছে। সেটা ছিল মারিউপোলের স্বাধীনতা চত্বর। ফুটেজে দেখা যায়নি, তবে এর সামনে ডান পাশে রয়েছে মারিউপোলের তিন নম্বর মাতৃসদন হাসপাতাল। গত বছর মার্চে নিষ্ঠুর বোমা হামলার শিকার হয়েছিল এ হাসপাতাল।
ওই বোমা হামলায় আহত হয়েছিলেন অন্তঃসত্ত্বা নারী মারিয়ানা ভিশেগিরস্কায়া। তাঁর রক্তাক্ত মুখ, ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে হেঁটে আসার ছবি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ হামলার নিন্দার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন মারিয়ানা এবং পরদিন তাঁর সন্তানের জন্ম হয়েছিল। আরেক অন্তঃসত্ত্বা নারীও বোমা হামলায় আহত হয়েছিলেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এ ঘটনাকে যুদ্ধাপরাধ আখ্যায়িত করেছিলেন। তবে রাশিয়ার লন্ডন দূতাবাস দাবি করেছিল, ওই হাসপাতালটি আর ব্যবহৃত হচ্ছিল না। উল্টো সেটা ব্যবহার করছিল ইউক্রেনের আধা সামরিক বাহিনী আজভ রেজিমেন্ট। ২০১৪ সালে আত্মপ্রকাশ করা আজভ রেজিমেন্ট পরবর্তী সময় ইউক্রেনের ন্যাশনাল গার্ডের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়েছিল।
পুতিন মাইরু অ্যাভিনিউয়ে চলা শেষ করেছেন থিয়েটার স্কয়ারে পৌঁছানোর আগে। ওই চত্বরেও ভয়াবহ বোমা হামলা হয়েছিল। ধারণা করা হয়, সেখানে বোমা হামলায় কমপক্ষে ৩০০ থেকে ৬০০–এর মতো বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিলেন। রাশিয়ার বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পাশাপাশি দুই পক্ষের তুমুল লড়াইয়ের মধ্যে ওই থিয়েটার ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন সাধারণ মানুষ। বোমা হামলায় ভবনটি ধসে পড়েছিল। ওই হামলার কথা অস্বীকার করে এর জন্য আজভ ব্যাটালিয়নকে দায়ী করেছিল রুশ কর্তৃপক্ষ। গত ডিসেম্বরে নির্বাসিত নগর কর্তৃপক্ষ জানায়, রুশ কর্তৃপক্ষ থিয়েটারের ধ্বংসাবশেষও সরিয়ে ফেলছে।
রাশিয়া নির্মিত কম্পাউন্ড পরিদর্শন
ফুটেজে দেখা গেছে, হেঁটে একটি নতুন আবাসিক এলাকা পরিদর্শন করছেন পুতিন। ধারণা করা হচ্ছে, এলাকাটি মারিউপোলের নেভস্কি অঞ্চল। তাঁকে পথ দেখিয়ে নিচ্ছিলেন খুসনুলিন। তিনি রুশ প্রেসিডেন্টের কাছে কিছু পুনর্নির্মাণ কাজের পরিকল্পনাও তুলে ধরছিলেন। তাঁকে সাধারণ লোকজনের সঙ্গেও কথা বলতে দেখা গেছে। রুশ গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ওই ব্যক্তিরা স্থানীয় বাসিন্দা।
নেভস্কি এলাকাটি মারিউপোলের পশ্চিমাঞ্চলে। সেখানে নতুন করে ডজনখানেক অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক তৈরি করা হয়েছে। এ অঞ্চলের নামকরণ করা হয়েছে নেভা নদীর নাম অনুসারে। প্রেসিডেন্ট পুতিনের নিজের শহর সেন্ট পিটার্সবার্গ নেভা নদীর তীরেই অবস্থিত।
মেয়র বয়চেঙ্কো বলেন, শহরের উপকণ্ঠে রাশিয়ানরা অনেক ভবন নির্মাণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তাঁরা এগুলো তৈরি করেছেন এটা দেখাতে যে এখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁরা যেসব বলছেন, তা যেন সত্য প্রমাণ করা যায়। কিন্তু তাঁরা মিথ্যা বলছেন। তাঁরা এ মিথ্যা বলছেন যে তাঁরা এই শহরকে মুক্ত করতে এসেছেন। বাস্তবে তাঁরা এটাকে ধ্বংস করেছেন। এ শহর আর অবশিষ্ট নেই। শহরকে আবার আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনতে কমপক্ষে ২০ বছর লাগবে।’
মারিউপোলের বাসিন্দারা বিবিসিকে বলেছেন, এক দিকে নতুন ভবন তৈরি করা হচ্ছে, আরেক দিকে রুশ হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেক ভবন সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। জাতিসংঘের হিসাবে, রাশিয়ার হামলায় মারিউপোলের ৯০ শতাংশের মতো আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে।
গত ডিসেম্বরে মারিউপোল ঘুরে আসা নরওয়েজিয়ান সাংবাদিক মর্টেন রিসবার্গ বলেন, চারদিকে শুধু ধ্বংস আর ধ্বংস। এর মধ্যে সেখানে বড় আঙ্গিকে পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে। তিনি বিবিসিকে বলেন, তাঁরা সড়কের নাম বদলে দিচ্ছে। ইউক্রেনের রঙের ওপর রাশিয়ার রং দিচ্ছে। সব জায়গায় রাশিয়ার পতাকা তুলছে। শহরে যেসব বাসিন্দা আছেন, তাঁরা শুধু কোনোভাবে টিকে থাকার ওপর জোর দিচ্ছেন।
ফিলহারমোনিক কনসার্ট হল
ফুটেজের আরেক অংশে প্রেসিডেন্ট পুতিনকে মারিউপোলের একটি কনসার্ট হলের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা গেছে। রুশ গণমাধ্যম বলছে, এটা ফিলহারমোনিক কনসার্ট হল। ওই হলের ভেতরের চিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে তা সঠিক দেখা গেছে। এটা সেই ভবন, যেখানে আটক ইউক্রেনীয় সেনাদের বিচার করা হবে বলে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছিল। গত আগস্টে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা ছবিতে দেখা যায়, মঞ্চের পেছনে বন্দী রাখার গরাদখানা বানানো হয়েছে। তবে পরে আর সেই বিচার হয়নি। রুশপন্থী ইউক্রেনিয়ান এমপি ভিক্টর মেদভেদচুকের বিনিময়ে ছাড়া পেয়েছিলেন ৫৫ জন ইউক্রেনিয়ান।
কনসার্ট হলের ভেতরের নতুন ফুটেজে দেখা গেছে, ভবনের ভেতরের সাজসজ্জা পরিবর্তন করা হয়েছে। সেখানে বন্দী রাখার গরাদখানাও নেই।
মারিউপোল যখন রুশ বাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে ছিল সে সময় থিয়েটারের মতো এ কনসার্ট হলেও আশ্রয় নিয়েছিলেন সাধারণ মানুষ।
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান চালানোর আগে এই কনসার্ট হলে ক্ল্যাসিক সঙ্গীতের আসর বসত। মেয়র বয়চেঙ্কো বলেন, ওই উৎসবে ইউক্রেনের অন্যান্য শহর এবং বিদেশ থেকেও শিল্পীরা আসতেন।
ফুটেজের আরেক অংশে দেখা গেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর কাছ থেকে শহরের দখল ফিরিয়ে নেওয়া সোভিয়েত সেনাদের স্মরণে নির্মিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ পরিদর্শন করছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন।