‘ব্ল্যাক হর্নেট’ ড্রোন কতটা কার্যকর, ইউক্রেনে কেন পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
ইউক্রেনে আরও ৪০ কোটি ডলারের অস্ত্র পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন প্রশাসন ঘোষিত নতুন এই অস্ত্রসহায়তার মধ্যে রয়েছে ‘ব্ল্যাক হর্নেট’ নামের বিশেষ একধরনের ড্রোন। তো এই ব্ল্যাক হর্নেট আসলে কী? কারা এই ড্রোন তৈরি করে? এ ড্রোন দামি কেন? আর কেনই বা রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ ধরনের এই ড্রোন ইউক্রেনে পাঠাচ্ছে?
যুক্তরাষ্ট্র এ দফায় ইউক্রেনকে যেসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেবে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে নাসমাস (স্বল্প পাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা), স্টিংগার (কাঁধে বহনযোগ্য আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা), প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, স্ট্রাইকার (সাঁজোয়া যান), টো ও জ্যাভেলিন (ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র), হাউৎজার কামানের গোলা, হিমার্স (রকেট–ব্যবস্থা) এবং ২ কোটি ৮০ লাখ রাউন্ড গোলাবারুদ।
ব্ল্যাক হর্নেট কী
ব্ল্যাক হর্নেট ন্যানো মূলত অত্যাধুনিক চালকবিহীন আকাশযান (ড্রোন)। পাখির মতো দেখতে এ ড্রোনের ওজন মাত্র ১৭ থেকে ১৮ গ্রাম। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১০০ মিলিমিটার এবং প্রস্থ প্রায় ২৫ মিলিমিটার। ভারী ও বড় না হওয়ায় সেনারা সর্বত্র এটা সঙ্গে রাখতে পারেন। বিশেষ এই ড্রোন যেখানে ওড়ানো হয়, তার আশপাশের এলাকার উচ্চ মানসম্পন্ন ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে পারে।
কারা তৈরি করে
২০১১ সালের দিকে নরওয়ের ক্ষুদ্র ড্রোন হেলিকপ্টার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান প্রক্স ডায়নামিকস্ এটি তৈরি করে। এখন এটি তৈরি করে এফএলআইআর আনম্যানড অ্যারিয়াল সিস্টেমস নামে নরওয়ের আরেকটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৬ সালে এই প্রতিষ্ঠান ১৩ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলারে প্রক্স ডায়নামিকসের মালিকানা কিনে নেয়। মূলত নজরদারি ও স্বয়ংক্রিয় আকাশযান, সাঁজোয়া যানের সরঞ্জাম, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ব্যবস্থা এবং অগ্নিনির্বাপণ ক্যামেরার জন্য এই ড্রোন পরিচিত।
কতটা শক্তিশালী
ব্ল্যাক হর্নেট একটানা সর্বোচ্চ ২৫ মিনিট আকাশে উড়তে পারে। এর গতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২১ কিলোমিটার। ব্ল্যাক হর্নেটের ভেতর থাকে ডিজিটাল ডেটা লিংক। এই লিংকের মাধ্যমে ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার দূর থেকে এ ড্রোনের মাধ্যমে ছবি ও ভিডিও ধারণ এবং তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করা যায়।
দাম কেমন
একটি ব্ল্যাক হর্নেটের দাম আনুমানিক দুই লাখ মার্কিন ডলার। এটা অবশ্য বর্তমান মূল্য নয়। এর বর্তমান মূল্য জানা যায় না। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই দামে ১৬০টি ব্ল্যাক হর্নেট কেনে। এ দামের মধ্যেই রিমোট কন্ট্রোলার, টাচ স্ক্রিন, চার্জযোগ্য ব্যাটারি দেওয়া হয়।
কারা ব্যবহার করে
২০১১ সালে প্রথমবার তৈরির পর ১৪ হাজারের বেশি ব্ল্যাক হর্নেট তৈরি করা হয়েছে। এর বেশির ভাগই কিনেছে নরওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র এবং সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য দেশগুলো। এর বাইরে কিনেছে আলজেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা।
প্রথমবার ব্যবহার
২০১৩ সালে প্রথমবার যুদ্ধক্ষেত্রে এই ড্রোনের ব্যবহার হয়। আফগানিস্তানে এর ব্যবহার করে ব্রিটিশ সেনারা। যুক্তরাষ্ট্রে এর ব্যবহার শুরু হয় ২০১৫ সালে; দেশটির মেরিন কোরের স্পেশ্যাল অপারেশন ইউনিটে। এরপরই ব্ল্যাক হর্নেট কিনতে ১৪ কোটি ডলারের চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র।
ইউক্রেনে কি প্রথম
তবে যুক্তরাষ্ট্রের আগেও ইউক্রেনে ব্ল্যাক হর্নেটের ব্যবহার হয়েছে। ইউক্রেনে প্রথমবার ব্ল্যাক হর্নেট পাঠায় যুক্তরাজ্য ও নরওয়ে। ২০২২ সালের আগস্টে দেশ দুটি ইউক্রেনের জন্য ৮৫০টি ব্ল্যাক হর্নেট কেনে। একই বছরের নভেম্বর থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী এই ড্র্রোনের ব্যবহার শুরু করে।
এটি কি সবচেয়ে ক্ষুদ্র ড্রোন
ব্ল্যাক হর্নেটকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্র সামরিক ড্রোন বলা হয়ে থাকে। তবে ২০১৫ সালের শেষ দিকে ব্রিটিশ গণমাধ্যমগুলো জানায়, দেশটিতে ব্ল্যাক হর্নেটের চেয়ে ছোট একটি ড্রোন তৈরির কথা চলছে, যার ওজন হবে পাঁচ গ্রাম। তবে তাদের সে পরিকল্পনা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
একই ধরনের ড্রোন
গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে প্রতিরক্ষা মেলায় ফেংনিয়াও (হামিংবার্ড) নামে ক্ষুদ্রাকার একটি ড্রোন প্রথমবার প্রকাশ্যে আনে হুয়াকিং ইনোভেশন নামে চীনের একটি প্রতিষ্ঠান। ড্রোনটির দৈর্ঘ্য ১৭০ মিলিমিটার। ওজন ৩৫ গ্রাম। এটি একটানা ২৫ মিনিট আকাশে উড়তে পারে। এই ড্রোন ব্যবহার করে দুই কিলোমিটার দূর থেকে উচ্চ মানসম্পন্ন ছবি এবং ভিডিও চিত্র ধারণ করা যায়।
কোন অস্ত্রে কাবু হয়
ক্ষুদ্রাকার ও শব্দ কম হওয়ায় প্রচলতি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ব্ল্যাক হর্নেটকে কাবু করা প্রায় দুঃসাধ্য। তবে বিশেষভাবে তৈরি আরএলকে–এমটি ভালদাই ব্যবহার করে এটিকে ধ্বংস করা সম্ভব। ভালদাই মূলত একটি বিশেষ রাডার। ছোট ও ক্ষুদ্রাকার নজরদারি ড্রোন ধ্বংসের লক্ষ্যেই এটি তৈরি করা। ভালদাই তৈরি করে থাকে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আলমাজ–অ্যান্টে।
এ ছাড়া ড্রোনবিধ্বংসী অস্ত্রব্যবস্থা পিএআরএস–এস স্তেপাশকা ব্যবহার করে ব্ল্যাক হর্নেটকে ধ্বংস করা সম্ভব। স্তেপাশকা প্রায় ১০ কেজি ওজনের মূলত একটি ড্রোন বিধ্বংসী বন্দুক। এটি ব্যবহার করে ড্রোন ভূপাতিত বা তাড়িয়ে দেওয়া যায়। এক থেকে দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত এ বন্দুক কার্যকর।
এতেও যদি কাজ না হয়, তাহলে স্টুপোর নামে বিশেষ একধরনের বন্দুক দিয়ে ব্ল্যাক হর্নেটকে ধ্বংস করা সম্ভব। এতে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক প্রযুক্তি আছে, যা দিয়ে ড্রোন নিয়ন্ত্রণ বা ভূপাতিত করা যায়।